টার্মিনাল ছাড়তে নারাজ চালকেরা

মাল নিয়ে দুয়ারেই আটক ট্রাকের বহর

পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের জেরে চেপে বসেছে খুচরোর আকাল। পরিণামে ওষুধ-বিষুদ, চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে খাবারদাবার— নাগালে এসেও রয়ে যাচ্ছে হাতের বাইরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১৭
Share:

পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের জেরে চেপে বসেছে খুচরোর আকাল। পরিণামে ওষুধ-বিষুদ, চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে খাবারদাবার— নাগালে এসেও রয়ে যাচ্ছে হাতের বাইরে। রাজ্যের সীমানায় সীমানায় বিভিন্ন টার্মিনালে আটকে রয়েছে পণ্যবোঝাই লরির বহর। কবে তারা রাজ্যে ঢুকবে, কোনও দিশা নেই।

Advertisement

যেমন, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্র থেকে ডেঙ্গি নির্ধারণের কিট নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল বেশ কিছু ট্রাক। ওড়িশা সীমানার জামশোল ও দাঁতনে এসে তারা থমকে রয়েছে। কারণ, তেল কেনা বা দৈনন্দিন খরচ চালানোর মতো খুচরো টাকা চালকদের হাতে নেই। নাসিক থেকে ফল, অন্ধ্র থেকে মাছ, কিংবা বাংলাদেশ থেকে সুতো-কাপড় আনা ট্রাকেরও একই দশা। অনেক ট্রাক রাজ্যের সীমানা পর্যন্তও পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই আটকে গিয়েছে।

ব্যাপারটা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই সরব হয়েছেন। ট্রাক-মালিকেরাও সুরাহা চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ। আর্জি গিয়েছে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকে। যদিও পরিস্থিতির বিশেষ বদল চোখে পড়ছে না। কিন্তু চালকদের বেশির ভাগ রাজ্যের সীমানায় এসেই কেন দাঁড়িয়ে থাকছেন? ভিতরে ঢুকছেন না কেন?

Advertisement

পরিবহণ মহলের ব্যাখ্যা: পণ্যবাহী লরি জাতীয় সড়কে যেখানে-সেখানে দাঁড়ায় না। রাজ্যের সীমানা বা চেকপোস্টের কাছে ট্রাক দাঁড়ানোর যে নির্দিষ্ট জায়গা (টার্মিনাল), সেখানেই চালক-খালাসিরা ঘাঁটি গাড়েন। ওই তল্লাটে নিরাপত্তা থাকে। চোর-ডাকাতের বিশেষ উৎপাত নেই। হাত বাড়ালেই খাওয়ার ধাবা, পানের জল, শৌচাগার, পেট্রোল পাম্প ইত্যাদি। উপরন্তু নিত্য যাতায়াতের সুবাদে ওখানকার পাম্প বা ধাবার লোকজনের সঙ্গে ট্রাক ড্রাইভার ও খালাসিদের একটা খাতিরদারির সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অনেক সময়ে ধারেও খাওয়া বা গাড়িতে তেল ভরার সুযোগ মেলে।

তাই সাধারণ সময়েও চালকেরা টার্মিনালে যাত্রাবিরতি দেন। এখন ছোট নোটের টানাটানির দিনে চালক-খালাসিরা টার্মিনালের পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে নড়তেই চাইছেন না। কারণ, ওঁদের সকলের কাছে মূলত পাঁচশো বা হাজারের নোট। টার্মিনালে তা দিয়ে যদিও বা কিছু কাজ চলে, অন্যত্র অকূল পাথারে পড়তে হবে। ‘‘রওনা করার সময়ে পথ-খরচা বাবদ বেশ কিছু টাকা চালকদের দেওয়া হয়। বেশিটাই পাঁচশো-হাজারে। খুচরো কম। যা থাকে, জলদি ফুরিয়ে যায়। এখনও তাই হয়েছে।’’— বলছেন এক ট্রান্সপোর্টার।

এবং তাঁর দাবি, ‘‘চালকেরা ঠিকই করছেন। টার্মিনাল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও আটকে গেলে সমস্যা আরও বাড়বে।’’ কেন?

ট্রাক-মালিকদের বক্তব্য: ট্যাঙ্কের অবশিষ্ট তেল দিয়ে কিছু ট্রাক হয়তো শহরে পৌঁছে যাবে। কিন্তু পাইকারি বাজারে খুচরো পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। তেল ভরতে না-পারলে চাকা গড়াবে না। অথচ শহরে অনির্দিষ্ট কাল ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। ‘‘শুধু জামশোল, দাঁতন নয়। আরও দূরের টার্মিনালগুলোতেও বহু ট্রাক থমকে রয়েছে।’’— আক্ষেপ এক পরিবহণ ব্যবসায়ীর। ঝাড়খণ্ড সীমানার চিরকুন্ডায় আটক এক চালকের মন্তব্য, ‘‘এখানে তা-ও কোনও ক্রমে চলে যাচ্ছে। বেরিয়ে ফাঁসব নাকি?’’

পরিবহণ-সূত্রের খবর: এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা সীমানার জামশোল-দাঁতন, ঝাড়খণ্ড সীমানার চিরকুন্ডা, অসম সীমানার বক্সিরহাটে বহু ট্রাক দাঁড়িয়ে। ডালখোলার বাংলা-বিহার সীমানাতেই জমে রয়েছে অন্তত সাতশো লরি। ফলে ব্যবসার আকাশে যেমন লোকসানের মেঘ, তেমন প্রশাসনও প্রমাদ গুনছে। কেননা ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না-পারলে ওষুধ-ফল, মাছের মতো একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নষ্ট হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তাতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি শুধু নয়, রাজ্যের বাজারেও টান পড়তে পারে বিলক্ষণ।

রাজ্যের ট্রাক-মালিকদের সংগঠন ‘ফে়ডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষের কথায়, ‘‘অসম, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা সীমানা ও বাংলাদেশের ঘোজা়ডাঙা সীমান্ত মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার ট্রাক দাঁড়িয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকার ওষুধ, ফল ইত্যাদি নষ্ট হওয়ার মুখে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীকে আমরা জানিয়েছি।’’

তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সমাধান-সূত্র মেলেনি। দেখে-শুনে অনেক মালিক এখন ট্রাক পথে নামাতেই সাহস পাচ্ছেন না। এর উপরে নোট সঙ্কটের বাজারে পণ্যপ্রবেশ কর নিয়েও ঝামেলা হচ্ছে বলে মালিকদের একাংশের অভিযোগ। কী রকম?

ওঁদের বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এন্ট্রি ট্যাক্স লাগবে না। কিন্তু অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্রের মতো নানা রাজ্য টাকা নিচ্ছে। অনেক জায়গাতেই পাঁচশো-হাজারের নোট চলছে না। পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা আপাতত সীমানায় এন্ট্রি ট্যাক্স নিচ্ছি না। ওভারলোডিং ও অন্যান্য তল্লাশি বন্ধ। কেননা জরিমানা নিতে গেলেও তো বড় নোট ঘিরে সমস্যা দেখা দেবে!’’

তা সত্ত্বেও অবশ্য ট্রাকের চাকা গড়ানোর অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না। দেশের পরিবহণ ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া মোটর ট্রান্সপোর্ট কংগ্রেস’ জানিয়েছে, তাদের কারবারে ৮০% লেনদেনই হয় ক্যাশে। এক ট্রাক-মালিকের প্রশ্ন, ‘‘এক দিকে খুচরো নেই। অন্য দিকে ব্যাঙ্ক থেকে সপ্তাহে ২৪ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না! চালাব কী ভাবে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন