দলিল-পত্র নিয়ে এখনও বিচারের আশায় সংগ্রামরা

পুরনো তমসুক হাতে নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন জেলাশাসকের কার্যালয়ের আশপাশে। কখনও বা কেউ কেউ সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে ঢুকে পড়ছেন দফতরের ভিতরে। আর ওদের দেখলেই কুঁকড়ে যাচ্ছেন জেলার কর্তারা। কখনও কেউ দেখাচ্ছেন দিসপুরের রাস্তা। কারও পরামর্শ, একেবারে রাজধানী দিল্লি।

Advertisement

শীর্ষেন্দু শী

করিমগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৫ ০২:৫২
Share:

পুরনো তমসুক হাতে নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন জেলাশাসকের কার্যালয়ের আশপাশে। কখনও বা কেউ কেউ সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে ঢুকে পড়ছেন দফতরের ভিতরে। আর ওদের দেখলেই কুঁকড়ে যাচ্ছেন জেলার কর্তারা। কখনও কেউ দেখাচ্ছেন দিসপুরের রাস্তা। কারও পরামর্শ, একেবারে রাজধানী দিল্লি।

Advertisement

গত পাঁচ দশক ধরে ওরা জমি হারা। ওরা মানে করিমগঞ্জ জেলার লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি, পাল্লাতলের ২২টি পরিবার। খান সেনারা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে দখল করে নিয়েছিল ওদের জমি। সেই থেকেই জমি ছিল পাকিস্তানের দখলে। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হল, ওদের জমি রয়েই গেল ওদের দখলে। তবু ওরা আশায় ছিল। এবং এই আশায় আশায় গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের দখলে থাকা জমির জন্য ভারত সরকারকে জমির খাজনা গুণে দিয়েছে ওরা। জমি নেই, কিন্তু খাজনা নিতে গিয়ে একবারও বিবেকে বাধেনি রাজ্য সরকার বা জেলা প্রশাসনের। এখন ২০১১ সালের সেই খাজনার রসিদ দেখে প্রশাসনিক কর্তারা মুখ ঘোরাচ্ছেন।

শীঘ্রই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নতুন মানচিত্রের হাতবদল হবে। ভারতীয় সংসদে ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে। চুক্তি মেনে মানচিত্র বদলাবে বরাকের করিমগঞ্জ জেলারও। দীর্ঘদিনের বিতর্ক থেকে মুক্ত হবে লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি এবং পাল্লাতল। আন্তর্জাতিক বিতর্ক মিটতে চললেও ‘কার জমি, কে দিচ্ছে’, এই প্রশ্ন তুলেছেন লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ির ২২টি পরিবারের মানুষ। জবাব নেই জেলা প্রশাসনের কারও কাছে। জমি হারা মানুষগুলির প্রশ্নের জবাব হয়তো দিল্লির কাছেও নেই।

Advertisement

বর্তমানে পুতনি বাগান এলাকায় বসবাসকারী ওই সব জমি মালিকদের অভিযোগ, ১৯৬৫-এর যুদ্ধে তাদের লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ির জমি তত্কালীন পাকিস্তান জবরদখল করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হলেও সেই জমি নিয়ে রাজনীতি-নির্বিশেষে ভারতীয় রাজনীতিকরা উচ্চবাচ্য করেননি। জমি সেই থেকেই বাংলাদেশের দখলে। বহু বার তাঁরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথাও হয়েছে। কিন্তু জমি ফিরে পাননি তাঁরা।

নতুন করে দুই দেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলে জমিহারা এই মানুষগুলি জমি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আশায় ছিলেন। কিন্তু ঘটল উল্টোটাই। অধিকাংশ জায়গায় সরকার স্থিতাবস্থার পক্ষেই মত দিয়েছে। দখলে থাকার দরুন লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ির জমি বাংলাদেশ পাকাপাকি ভাবে পেতে চলেছে।

ফলে কাগজপত্র থাকলেও বংশ পরম্পরায় লাভ করা জমির মালিকানা পাচ্ছেন না তাঁরা। আর এ নিয়ে আদালতে মামলা করারও কোনও সুযোগ নেই গরীব মানুষগুলির। নানা মুখে ক্ষতিপূরণের কথা শুনলেও তাঁদের সঙ্গে কেউ কোনও কথা এখনও বলেননি। তাদের বক্তব্যকে গুরুত্বও দিচ্ছেন না কেউ। জেলাশাসক, বিএসএফ কর্তা কিংবা ভূমি বন্দোবস্ত দফতরের অফিসার—সবার এক বক্তব্য, ও সব আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী হচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। আর নিস্ফল হতাশায় ভুগছেন ভারত-বাংলা সীমান্তের লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি এলাকার জমি মালিকরা। তাঁরা ভারত সরকারের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না। নথিপত্র নিয়ে এখনও দরজায় দরজায় ঘুরছেন, বাংলাদেশের দখলে থাকলেও ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে জমির খাজনা আদায় করেছে। ২০১১ সালের সেই খাজনার রসিদও রয়েছে কারও কারও হাতে। জমি আদায়ের মুরোদ না থাকলে কেন খাজনা নেওয়া হল, প্রশ্ন তাঁদের। এই উত্তরও নেই জেলাশাসক থেকে ভূমি রাজস্ব দফতরের কর্তাদের।

শুধু চার বছর আগের খাজনার রসিদ নয়, ১৯৩৪-এর প্রতাপগড় মৌজার ৪ নম্বর চালান, দাগ নম্বর ৬৫৯৫-১৯-এর মালিকানার কাগজও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। সংগ্রাম গোয়ালা ১৯৪৫ সালে জমির পাট্টা সংগ্রহের কাগজ তুলে ধরছেন চোখের সামনে। পাট্টার নম্বর ৬৪১-৫, দাগ নম্বর ১০৩-১৪৬। পাথারকান্দি সার্কল অফিসে পরে নতুন দাগ নম্বর পড়েছে, ১১৭। ২০০০ সালের ২৫ এপ্রিলও সেই জমির খাজনা জমা করেছেন সংগ্রাম। দাগ নম্বর ৫৯৫২-৫ চালানের ক্রমিক নম্বর ১১ অনুসারে ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর খাজনা জমা দেওয়ার রসিদ দেখাচ্ছেন সাহাদত মিয়া। এত নথিপত্র থাকার পরও সেই জায়গা বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে ভারত? বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চান ডুমাবাড়ির জমি মালিক ভাগীরাহি কৈরি, রামভারত রাজভর, রামধনী কৈরি, রামপ্রসাদ ভর, রঘুবীর কৈরি, দেবনারায়ণ চৌহান, সীতারাম গোয়ালা, মঙ্গলি রায়, রামবরণ গোয়ালা, দশরথ গোয়ালা, শিব গোয়ালা। একই প্রশ্ন লাঠিটিলার ত্রিভুবন উপাধ্যায়, গয়া ভর, হরিনন্দন গোয়ালা, গঙ্গাবিষ্ণু কানু, গোপালরাম কানু, জয়হিন্দ কৈরি ও কালীচরণ ভরের। লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ির যে অংশ বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হবে সেই জায়গার দলিল, জমির মালাকানার জমাবন্দির কাগজপত্রও হাতে নিয়ে জেলা সদরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু জেলার কর্তারা ‘দিসপুর থেকে দিল্লি’ দেখিয়ে দিয়েই খালাস, এ বার তোমরা ঘুরে মর!

লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি এলাকার জমি মালিকদের বক্তব্য, সরকার জনগণের সঙ্গে আলোচনা না করে তাদের জমি অন্য দেশকে হস্তান্তর করতে পারে না। দিতে হলে আগে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমির উপর তাঁদের দাবি প্রত্যাহার করাতে হয়। সে ধরনের কোনও উদ্যোগ এ পর্যন্ত ভারত সরকার গ্রহণ করেনি। ক্ষতিপূরণ ছাড়া ওই এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া বসাতে দেবেন না বলে এখন নিষ্ফল হুমকি দিচ্ছেন কোণঠাসা মানুষগুলি। এমনকী আত্মবির্সজনের হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন পুতনিবাগানে বসবাসকারী, পাঁচ দশক আগে দখল হয়ে যাওয়া লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ির সেই জমির মালিকরা।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন