টেলিভিশনে নোট বাতিলের ঘোষণা করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন— যা করছেন, সবই গরিবের মঙ্গলের জন্য। এতে গরিবের লাভ হচ্ছে, ঘুম ছুটেছে বড়লোকদের। কিন্তু নোট বাতিলের ফলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়েছেন, নোটের অভাবে ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য যে ভাবে লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে, তাতে তাঁর গরিব-দরদি ভাবমূর্তিই আজ বিরোধীদের নিশানায়। এমন একটি সিদ্ধান্ত কর্মী ও অনুগত শিল্পপতিদের আগাম জানিয়ে দেওয়ার অভিযোগও তুলেছেন বিরোধীরা, যৌথ সংসদীয় দল গড়ে যার তদন্তের দাবি উঠেছে সমস্বরে।
প্রধানমন্ত্রী নিজেকে গরিবদের মসিহা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বড়লোক ও গরিবের মধ্যে ভেদাভেদ মুছে গিয়ে আর্থিক সাম্য এসেছে বলে ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন মোদী। এই সিদ্ধান্তে গরিবদের আনন্দ হচ্ছে, বড়লোকের যন্ত্রণা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করছেন তিনি। অতীতে নিজের চা বিক্রির জীবনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন, গরিবরা কড়া চা পছন্দ করেন, বড়লোকদের যা অপছন্দ। পুরনো নোট বাতিলও সেই কড়ক চায়ের মতোই।
অনেক মোদীভক্ত বলছেন, এক সময় ইন্দিরা গাঁধী ‘গরিবি হটাও’-এর ডাক দিয়েছিলেন। মোদীর মধ্যেও যেন সেই ‘সাম্যবাদী’ ইন্দিরার ছবি দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এক কদম এগিয়ে তাঁকে ‘সমাজবাদী’ আখ্যাও দিচ্ছেন।
আমার মারি আঁতোয়ানেত-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় যিনি বলেছিলেন, ‘লোকে রুটি না পেলে কেক খাচ্ছে না কেন?’ আমাদের এখন মোদী আঁতোয়ানেত আছেন। তিনি বলছেন, নোট না থাকলে প্লাস্টিক (মানি) ব্যবহার করছেন না কেন?
সীতারাম ইয়েচুরি | সাধারণ সম্পাদক সিপিএম | বুধবার সংসদে
লোকসভা ভোটের ঠিক আগে অনেকেই ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে মোদী উদারপন্থী অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর মন্ত্র নিয়েই সংস্কারের কড়া দাওয়াই আনবেন। কিন্তু যে কোনও সিদ্ধান্তকেই গরিবদের পক্ষে বলে দাবি করেছেন মোদী। তাঁর সরকারের বাজেটও গরিব, কৃষকদের জন্য ভেবেই তৈরি। এ বার পুরনো নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধীরা যখন মানুষের ভোগান্তিকে হাতিয়ার করতে চাইছেন, তখনও মোদী একে বড়লোকের বিরুদ্ধে গরিবের জেহাদ আখ্যা দিতে চাইছেন। ওই সিদ্ধান্তের পরে গোয়া ও গাজিপুরে মোদী বলেছেন, একটু অসুবিধা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কালো টাকার কারবারিদের যন্ত্রণা দিতে গরিবরা এই কষ্টটুকু মানতে রাজি। জনতার কাছে তিনি প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘আপনারা কি আমাকে ২০১৪-য় এই কাজই করতে বলেননি?’’
ইউপিএ আমলে মনমোহন সিংহ সংস্কারের রথ ছোটাতে চাইলেও, গরিব-দরদি প্রকল্পের দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন ইন্দিরার পুত্রবধূ সনিয়া গাঁধী। প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে মোদী যেন সনিয়ার হাত থেকে সেই ব্যাটন নিতে চেয়েছেন। কিন্তু সনিয়া-তনয় রাহুলই মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ তকমা দিয়েছিলেন। মোদী দশ লক্ষ টাকার স্যুট পরে বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠক করতে বসায়, এই তকমা সেঁটে দিতে অসুবিধা হয়নি।
এ বার সেই তকমাই ঝেড়ে ফেলে গরিব-দরদি হয়ে উঠতে চাইছেন মোদী। কিন্তু এই ভাবমূর্তির কতখানি আসল, তা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মার প্রশ্ন, ‘‘কাদের দুর্নীতিগ্রস্ত, কালো টাকার কারবারি বলছেন প্রধানমন্ত্রী? যাঁরা নার্সিংহোমে পুরনো নোট চালাতে না-পেরে চিকিৎসা করাতে পারছেন না? যাদের ছোট কারবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে?’’
নোট বাতিলের যে সিদ্ধান্তকে মোদী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ বলে তকমা দিচ্ছেন, এ দিন সংসদে তা নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ তুললেন বিরোধীরা। আনন্দ শর্মা থেকে শরদ যাদব, মায়াবতী থেকে সীতারাম ইয়েচুরি— প্রত্যেকেই বলেন, ৮ তারিখ রাতে বড় নোট বাতিলের ঘোষণা করেন মোদী। তার কয়েক দিন আগেই বিজেপির নেতা-কর্মীরা বহু বড় নোট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিও ৮ তারিখের আগে তিন কোটি টাকা তড়িঘড়ি ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকী বিজেপি অনুগত বহু শিল্পপতিও আগাম বিষয়টি জেনে বড় নোট ব্যাঙ্কে জমা দেন বলে খবর। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অবশ্য তথ্য ফাঁসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘সব ভিত্তিহীন কথা!’’ তবে এই ‘দুর্নীতি’র তদন্তে যৌথ সংসদীয় দল (জিপিসি) গড়ার দাবি তুলেছেন আনন্দ-শরদরা। যদিও তৃণমূল এই দাবির পাশে দাঁড়ায়নি। তৃণমুল সাংসদদের বক্তব্য, জেপিসি গড়ে কোনও কাজের কাজ হয় না।
সিপিএম নেতা ইয়েচুরির কটাক্ষ, ‘‘ফ্রান্সের দুর্ভিক্ষের সময় রানি মারি আঁতোয়ানেত নাকি বলেছিলেন, রুটি নেই তো ওরা কেক খাক! এখন আমাদের মোদী আঁতোয়ানেত বলছেন— কাগজের নোটের অভাব তো তোমরা প্লাস্টিক মানি ব্যবহার করো! কাদের নিয়ে তামাসা করছেন মোদী? যে চাষি ধান বেচতে পারছেন না, যে জেলে মাছ ধরে বিক্রি করতে পারছেন না, তাঁরা কি ডেবিট কার্ডে লেনদেন করবেন?’’ তিনি জানান, দেশে ১৩০ কোটি মানুষ, আর প্লাস্টিক কার্ড রয়েছে ২.৬ কোটি।
উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে মোদীর এই সিদ্ধান্তের যে রাজনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে, তা বিজেপি নেতারাও মানছেন। কারণ রবি ফসল বোনার কাজে বাধা পড়লে বা ছোট ব্যবসা মার খেলে তার দায় একা মোদীকেই নিতে হবে। আবার সফল হলে মোদী নিজের কর্তৃত্ব আরও মজবুত করে ফেলবেন। আরএসএসের সঙ্গে দর কষাকষিতেও তাঁর দিকেই পাল্লা ঝুলে থাকবে।
মারি আঁতোয়ানেত
(১৭৫৫-১৭৯৩)
ফ্রান্সের রানি। স্বামী সম্রাট ষোড়শ লুই। ১৭৮৯ সালে তাঁর রাজত্বকালেই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা। বুরবোঁ রাজতন্ত্র প্রথমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হল। অর্থনীতির চরম দুর্দিনে প্যারিসে তখন রুটির আকাল। সে সময়ই মারি ‘রুটি না পেলে কেক খাচ্ছে না কেন’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি। যদিও ইতিহাসে এর কোনও প্রমাণ নেই। ১৭৯১ সালে রাজতন্ত্র পুরোপুরি বিলোপ করে ক্ষমতায় আসে বিপ্লবী সরকার। তার আগেই অবশ্য মহিলারা রাস্তায় নেমে রাজা-রানিকে রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে বের করেছিলেন। ১৭৯৩ সালে ষোড়শ লুই এবং মারি দু’জনকেই গিলোটিনে হত্যা করা হয়।