খোদ যুদ্ধসচিবের ‘মূর্খামি’তে ফাঁস ফৌজের যাবতীয় গতিবিধি! শুধু তা-ই নয়, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দিব্যি বাহিনীর উপর ঝটিতি হামলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহীরা। এ-হেন বিস্ফোরক অভিযোগে বেজায় বিপাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য পিট হেগসেথ। মুখ লুকোতে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন তিনি। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকার ঘরোয়া রাজনীতিতে উঠেছে সমালোচনার ঝড়, যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টিকে।
সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়ায় বিভিন্ন অভিযানে যুক্ত মার্কিন ফৌজের সুরক্ষার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’কে সতর্ক করেন সেখানকার যুদ্ধ সদর দফতর পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ একটি নজরদারি সংস্থা। তাদের দাবি, বাহিনীর কাছে সরকারি নির্দেশ পৌঁছে দিতে ‘সিগনাল’ নামের মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করছেন দফতরের সচিব পিট হেগসেথ। এর জেরে ঝুঁকির মুখে পড়ছে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় থাকা আমেরিকান সৈনিকদের জীবন।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’। তাদের দাবি, পেন্টাগনের নজরদারি সংস্থাটির রিপোর্টে পিটের এই পদক্ষেপকে ‘বেআইনি’ এবং সরকারি নীতি লঙ্ঘনের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, ব্যক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার করে বাহিনীকে যাবতীয় নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ফলে সংশ্লিষ্ট মেসেজিং অ্যাপ থেকে যাবতীয় তথ্য ফাঁসের আশঙ্কা ছিল ষোলো আনা। যদিও পশ্চিম এশিয়ায় কোনও মার্কিন সৈন্যের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর একাধিক বার ইরান মদতপুষ্ট ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের উপর বিমানহামলা চালায় আমেরিকার বায়ুসেনা। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেন্টাগনে বসে সংশ্লিষ্ট সামরিক অভিযানগুলির যাবতীয় নির্দেশ ‘সিগনাল’ অ্যাপেই দেন যুদ্ধসচিব পিট। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট তৈরি করতে দু’জন আধিকারিক সাহায্য করেছেন বলেও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই নজরদারি সংস্থা।
পেন্টাগনের নজরদারি সংস্থার রিপোর্ট মার্কিন ‘কংগ্রেস’-এ জমা পড়তেই ইনস্পেক্টর জেনারেল পদমর্যাদার আধিকারিকের সামনে হাজিরা দেওয়ার সমন পান যুদ্ধসচিব। যদিও তা অগ্রাহ্য করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে পার্লামেন্টকে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ হেগসেথ। আত্মপক্ষ সমর্থনে সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘সামরিক অভিযান বিপন্ন হবে এমন কোনও নির্দেশ সিগনাল অ্যাপে দেওয়া হয়নি।’’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করা হচ্ছে বলেও পাল্টা সুর চড়িয়েছেন তিনি।
গত সেপ্টেম্বরে মাদক চোরাচালানের অভিযোগে ক্যারিবিয়ান সাগরে একটি নৌকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় মার্কিন নৌসেনা। এতে সংশ্লিষ্ট জলযানটি ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে যান এর কয়েক জন আরোহী। আমেরিকার পার্লামেন্টের সদস্যদের একাংশের দাবি, বিনা বিচারে তাঁদের হত্যার নির্দেশ দেন যুদ্ধসচিব পিট। সেই আদেশও নাকি ‘সিগনাল’ অ্যাপে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে কথিত ‘খুনের’ বিষয়টি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’।
সেপ্টেম্বরের ওই সেনা অভিযানের পর আমেরিকার ঘরোয়া রাজনীতি উত্তাল হলে জনসমক্ষে সাফাই দেন হেগসেথ। একটি বিবৃতিতে যুদ্ধসচিব বলেন, ‘‘ঘন কুয়াশার মধ্যে ক্যারিবিয়ান সাগরে মাদকবোঝাই নৌকায় আঘাত হানে আমাদের নৌসেনার বিমানবাহিনী। ওই সময় সংশ্লিষ্ট জলযানে জীবিত কাউকে দেখতে পাওয়া যায়নি। নৌকাটিকে ডোবানোর জন্য দ্বিতীয় বার আঘাতের প্রয়োজন ছিল।’’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত কমান্ডার এ ব্যাপারে তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে স্পষ্ট করেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ পিট।
মার্কিন যুদ্ধসচিবের আরও দাবি, কোনও ধরনের সামরিক অভিযানের নির্দেশ ‘সিগনাল’ অ্যাপে দেওয়া হচ্ছে না। পদ্ধতি মেনে ‘ক্লাসিফায়েড’ নীতিতে সংশ্লিষ্ট অপারেশনের আদেশ পাচ্ছে ফৌজ। আর তাই সৈনিকদের জীবন বিপন্ন হওয়া বা অভিযান ঝুঁকির মুখে পড়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ-হেন সাফাইয়ের পরেও ঘরের মাটিতে সমালোচনার ঝড় থামাতে পারেননি পিট হেগসেথ।
পেন্টাগনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ লিখেছে, সেপ্টেম্বরের অভিযানের সময়ে ‘সিগনাল’ মেসেজিং অ্যাপের দু’টি গ্রুপে হামলার সঠিক সময়ের বিবরণ দিয়ে বিশেষ নির্দেশ দেন মার্কিন যুদ্ধসচিব হেগসেথ। সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলিতে ওই সময় ছিলেন ‘দ্য আটলান্টিক’-এর সাংবাদিক জ়েফ্রি গোল্ডবার্গ এবং সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ়। বাহিনীকে বার্তা পাঠানোর সময় পিট এ সব কিছু খেয়াল করেননি বলেও উঠেছে অভিযোগ।
আমেরিকার যুদ্ধ সদর দফতরের নজরদারি সংস্থাটির রিপোর্ট অনুযায়ী, দিনভর যাবতীয় কাজের খতিয়ান সাধারণত ‘সিগনাল’ অ্যাপের দু’টি গ্রুপে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পাঠিয়ে থাকেন হেগসেথ। তার মধ্যে একটিতে রয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স, বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খুব ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েক জন। অপর গ্রুপটি তাঁর পারিবারিক। সেখানে রয়েছেন পিটের স্ত্রী ও ভাই-সহ মোট ১৩ জন সদস্য। তাঁদের সঙ্গেও সেনা অভিযানের মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।
‘সিগনাল’ মেসেজিং অ্যাপটি কতকটা হোয়াট্সঅ্যাপের মতো। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা নির্দ্বিধায় এবং নিখরচায় এটি ব্যবহার করতে পারেন। ২০১৪ সালে বাজারে আসা সংশ্লিষ্ট অ্যাপটির নির্মাণকারী সংস্থার দাবি, এতে সুরক্ষিত থাকে গ্রাহকের গোপনীয়তার অধিকার। যদিও সাইবার হামলা চালিয়ে একে কখনওই হ্যাক করা যাবে না, সে কথা মানতে নারাজ দুনিয়ার দুঁদে সেনা অফিসার থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
আর তাই এ ব্যাপারে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর কাছে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেন্টাগনের এক পদস্থ কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের যুদ্ধ দফতরে সেনা অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাঁদের কাছে সরকারি নির্দেশ পৌঁছে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেটা কখনওই বাজারের কোনও মেসেজিং অ্যাপ নয়। কোনও অভিযানের বিবরণ বা হামলার সময়সূচির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলি অনিরাপদ ডিভাইসে ভাগ করা যেতে পারে না।’’
সূত্রের খবর, ‘সিগনাল’ অ্যাপে মার্কিন ফৌজকে দেওয়া পিটের নির্দেশাবলি সংক্রান্ত স্ক্রিনশট গণমাধ্যমে ভাইরাল করেন ‘দ্য আটলান্টিক’-এর সাংবাদিক জ়েফ্রি গোল্ডবার্গ। এর পরই ঘনিষ্ঠমহলে বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন আমেরিকার যুদ্ধসচিব। সেখানে নাকি পেন্টাগনের ইনস্পেপেক্টর জেনারেলের উপর অনাস্থা প্রকাশ করেছেন তিনি। অন্য দিকে, এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছেন তাঁর প্রেস সেক্রেটারি কিংসলে উইলসন। হেগসেথের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগকে ‘ডাইনিদের খোঁজ’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি তুলেছে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট মার্কিন পার্লামেন্ট। হেগসেথের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছে ‘কংগ্রেস’-এর উচ্চকক্ষ সেনেটের সদস্য তথা রিপাবলিকান পার্টির নেতা রজ়ার উইকার। এ ছাড়া তালিকায় নাম আছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সেনেটর জ্যাক রিডেরও। পেন্টাগনের নজরদারি সংস্থাটিকেও তদন্তের আওতায় আনার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। পিটের দফতরের বেশ কয়েক জন জুনিয়ার কর্মীর চাকরি যেতে পারে বলেও তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
সম্প্রতি রুশ সাইবার হামলা নিয়ে পশ্চিমি দুনিয়াকে সতর্ক করেছেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যান ইটালীয় নৌসেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল জিউসেপ্পে কাভো ড্রাগনে। তাঁর কথায়, ‘‘একাধিক সতর্কতা সত্ত্বেও মস্কোর হ্যাকিং আটকানো গিয়েছে, এমনটা নয়। ক্রেমলিন যে ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার উপর জোর দিয়েছে, তা সত্যিই বিপজ্জনক।’’
নেটোর মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যানের ওই মন্তব্যের পরই ‘সাইবার’ অ্যাপে বাহিনীকে ‘নির্দেশ’ দেওয়াকে কেন্দ্র করে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন মার্কিন যুদ্ধসচিব। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পিটের বিরুদ্ধে এমন একটা সময়ে এই অভিযোগ উঠেছে যখন মাদক পাচারের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ভেনেজ়ুয়েলায় সামরিক অভিযান পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন ট্রাম্প। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিকে ইতিমধ্যেই রণতরী দিয়ে ঘিরে ফেলেছে তাঁর সেনা।
সাবেক সেনাকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, পিটের ‘বোকামি’র পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে চিন। রাশিয়ার মতোই সাইবার হামলা, শত্রুর হাঁড়ির খবর জোগাড়ের জন্য বিভিন্ন গ্যাজেটে আড়িপাতার ক্ষেত্রে বেজিঙের গুপ্তচর সংস্থা ‘মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি’ বা এমএসএসের জুড়ি মেলা ভার। সে দিক থেকেও বিপদ বাড়তে পারে আমেরিকার।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য হওয়ায় বড় শাস্তি এড়ানোর সুযোগ রয়েছে পিটের। তাঁর জন্য সাফাই দিতে আসরে নামতে পারেন স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আগামী বছর ‘মিড টার্ম’ নির্বাচন রয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অবশ্য এই ইস্যু রিপাবলিকানদের ভরাডুবির কারণ হতে পারে বলেও আগাম ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা।