অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা বলিউড। জয়পুরে ‘পদ্মাবতী’ ছবির সেটে কাল তাণ্ডব চালিয়েছে ‘রাজপুত করণী সেনা’। চড়-থাপ্পড় মেরেছে পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভংসালীকে। ভাঙচুর করেছে সেটের যন্ত্রপাতি। এর তীব্র প্রতিবাদ করে আজ ভংসালীর পাশে থাকারই বার্তা দিল বলিউ়ড। ইন্ডাস্ট্রির সকলকে এমন আক্রমণের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার ডাক দিয়েছেন পরিচালক কর্ণ জোহর। একই সুর শোনা গিয়েছে পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের গলাতেও। গত কালের ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বলিউডের অন্য তারকা, পরিচালক প্রযোজক ও কলাকুশলীরা। স্তম্ভিত ‘পদ্মাবতী’ দীপিকা পাড়ুকোন। তাঁর কথায় ‘‘এই ছবিতে কোথাও ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়নি।’’ করণী সেনা অবশ্য নির্বিকার। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ থেকে সরে আসেনি তারা।
এই অসহিষ্ণুতা প্রথম নয়। অতীতে জোধা-আকবর ছবির শ্যুটিংয়ের সময়েও একই অভিযোগ তুলে গণ্ডগোল পাকিয়েছিল তথাকথিত জাতীয়তাবাদী এই রাজপুত সংগঠনটি। এ বারে তাদের দাবি, আলাউদ্দিন খিলজির হাত থেকে বাঁচাতে জহর ব্রত করেছিলেন রানি পদ্মিনী। ছবিতে দু’জনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত দেখানো হয়েছে। ভংসালী প্রযোজনা সংস্থার সিইও শোভা সন্ত আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ছবিতে এমন কোনও ঘটনা দেখানো হবে না। ভংসালীও বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে পদ্মাবতীর কোনও আপত্তিকর দৃশ্য ছবিতে নেই। স্বপ্ন-দৃশ্যও নয়।’’ ভংসালীর খেদ, ‘‘এই দেশে ছবি বানালে কখনও-সখনও এমন অপমান সইতে হয়।’’ হামলার পরেই জয়পুরে শ্যুটিং বাতিল করে মুম্বই ফেরার কথা জানিয়েছেন তিনি। এই হামলার পরে রাজস্থানের বিজেপি সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কালই। আজ মুখ খুলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু। তাঁর মতে, হামলা, শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়ার এই ঘটনা ‘খুবই আপত্তিকর’।
গোটা ঘটনায় হতবাক ছবির মুখ্য চরিত্রে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। টুইটারে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন দীপিকা পাড়ুকোন। তাজ্জব এই ছবির ‘আলাউদ্দিন খিলজি’ রণবীর সিংহ ও ‘রাজা রতন সিংহ’ শাহিদ কপূর। রণবীরের বক্তব্য, ‘‘কারও ভাবাবেগকে আঘাত করতে এই ছবি হচ্ছে না। রাজস্থানের মানুষ ও রাজপুত সম্প্রদায়ের আবেগকে মাথায় রেখেই এটি বানানো হচ্ছে। কাল যা ঘটেছে, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’
ভংসালীর উপর হামলার পরেই মুখ খোলেন কর্ণ জোহর। তাঁকেও ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ ছবি নিয়ে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে এমন অসহিষ্ণুতার মুখে পড়তে হয়েছিল। ছবিতে পাক শিল্পী থাকায় মুক্তির সময় ব্যাপক ঝামেলা হয়। ক্ষুব্ধ কর্ণের টুইট, ‘‘ভীষণ রাগ হচ্ছে। এটা কখনওই আমাদের ভবিষ্যৎ হতে পারে না। কোনও কিছু নিয়ে স্বাধীন ভাবে বলার অধিকার রয়েছে এক জন পরিচালকের।’’ পরিচালক রামগোপাল বর্মার খেদ, ‘‘এর পরে তো কুকুর, বাঁদর, এমনকী গাধাও সেন্সর বোর্ড হয়ে উঠবে!’’ করণী সেনাকে মেরুদণ্ডহীন আখ্যা দিয়ে নিন্দায় সরব হয়েছেন সেলিম খানও। অনুষ্কা শর্মার টুইট, ‘সঞ্জয়ের সঙ্গে যা হল সেটা চূড়ান্ত লজ্জার।’ ক্ষুব্ধ প্রিয়ঙ্কা চোপড়া লিখেছেন, ‘পূর্বপুরুষরা তো আমাদের হিংসা ছড়াতে শেখাননি।’ ফারহান আখতার বলেছেন, ‘যদি সঞ্জয়ের তৈরি ছবি পছন্দ না হয়, দেখবেন না। হিংসা ছড়ানোর তো কোনও মানে নেই।’
নিন্দার এই ঝড়ের মুখেও অটল করণী সেনার প্রতিষ্ঠাতা লোকেন্দ্র সিংহ কালভি। তিনি আজ বলেন, ‘‘আমি কোনও রকম হিংসাকে সমর্থন করি না। করণী সেনা গিয়েছিল ছবির বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে এবং ভংসালীর সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু পরিচালক কথা বলতে চাননি। এর পরেই তাঁর রক্ষীরা শূন্যে গুলি ছোড়ে। আর তাতেই বিপত্তি।’’ ভংসালীর মতে, কাল যা হয়েছে তা, পুরোপরি অবাঞ্ছিত।
এর আগে চিতোরের রানি পদ্মিনীর জীবন অবলম্বনেই ‘পদ্মাবতী’ নাটকের নির্দেশনা করেছেন ভংশালী। প্যারিসে তা ভাল সাড়া পেয়েছিল। একই চরিত্র নিয়ে ছবি তৈরি করতে গিয়ে জট পাকাল জয়পুরে। কী বলছেন ইতিবাসবিদরা? ইরফান হাবিব জানাচ্ছেন, মহম্মদ জায়সি এই পদ্মাবতী চরিত্রটির স্রষ্টা। ১৫৪০ সালে তাঁর লেখা প্রেমের কবিতা ‘পদ্মাবত’-এ এই চরিত্রটি ছিল। ওই চরিত্রটি যদি কাল্পনিক হয়, তা হলে ভংসালী ইতিহাসকে বিকৃত করছেন বলে মনে হয় না। ভাবনা বা সৃষ্টিশীলতার দিকটাই ওঁরা বুঝতে পারছেন না। বলিউ়ডের অনেকেই কিন্তু বলছেন, এই না-বোঝাটা ইচ্ছাকৃত। অসহিষ্ণুতা ছড়াতে বারবার ‘সহজ নিশানা’ করা হচ্ছে বলিউডকে।
• এই দেশে ছবি বানালে কখনও-সখনও এমন অপমান সইতে হয়। সঞ্জয় লীলা ভংসালী
• এখনও ঘোরের মধ্যে রয়েছি। কালকের ঘটনায় আমি মর্মাহত। #পদ্মাবতী। দীপিকা পাড়ুকোন
• বলিউডের কেউ চুপ করে থাকবেন না। এটাই একজোট হওয়ার সময়। কর্ণ জোহর
• করণী সেনা যা করেছে, তাতে এক জন রাজপুত হিসেবে আমার লজ্জা হচ্ছে। অনুরাগ কাশ্যপ
• হামলা, শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়ার এই ঘটনা খুবই আপত্তিকর। বেঙ্কাইয়া নায়ডু
ভ্রম সংশোধন: শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকার কিছু সংস্করণে ‘পদ্মাবতীর সেটে ভংসালীকে চড়’ শীর্ষক খবরে ‘জোধা আকবর’-এর পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভংসালী লেখা হয়েছে। এটির পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।