বরাক-বাগান

মজুরি-বৈষম্য কমানোর সরকারি আশ্বাসে আশাবাদী শ্রমিকরা

এক রাজ্য, একই জীবনশৈলী! এক বাজার দর, একই রেশনহার! তবু ব্রহ্মপুত্রের সমান মজুরি মেলে না বরাক উপত্যকার চা শ্রমিকদের! ১৯৫২ সালে এই অসমতায় সিলমোহর লাগিয়েছিল তৎকালীন অসম সরকার। ৬৫ বছরেও সেই ব্যবধান দূর হয়নি। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলন করেছে। বাগান কর্তৃপক্ষ সে সব কথা কানে তুলতে নারাজ। ব্যবধানটা বরং ক্রমে বেড়ে চলেছে। সরকার বিভিন্ন সময় কমিটি গড়লেও ফল বিশেষ হয়নি। এমন বৈষম্য ঠিক নয় বলে এখন অবশ্য মন্তব্য করছেন মন্ত্রীরা। তা কমানোর চেষ্টা চলছে বলেও দাবি করছেন তাঁরা। কিন্তু যথাপূর্বম তথাপরম।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৫
Share:

বরাকের চা-বাগান। ছবি: পার্থ শীল।

এক রাজ্য, একই জীবনশৈলী! এক বাজার দর, একই রেশনহার! তবু ব্রহ্মপুত্রের সমান মজুরি মেলে না বরাক উপত্যকার চা শ্রমিকদের!

Advertisement

১৯৫২ সালে এই অসমতায় সিলমোহর লাগিয়েছিল তৎকালীন অসম সরকার। ৬৫ বছরেও সেই ব্যবধান দূর হয়নি। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলন করেছে। বাগান কর্তৃপক্ষ সে সব কথা কানে তুলতে নারাজ। ব্যবধানটা বরং ক্রমে বেড়ে চলেছে। সরকার বিভিন্ন সময় কমিটি গড়লেও ফল বিশেষ হয়নি। এমন বৈষম্য ঠিক নয় বলে এখন অবশ্য মন্তব্য করছেন মন্ত্রীরা। তা কমানোর চেষ্টা চলছে বলেও দাবি করছেন তাঁরা। কিন্তু যথাপূর্বম তথাপরম।

প্রতি তিন বছর অন্তর চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে বরাক-ব্রহ্মপুত্রে একই নিয়ম। ২০১২ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রতিটি শ্রমিকের মজুরি স্থির হয়, দৈনিক ৯৬ টাকা। ওই একই সময়ে বরাক উপত্যকায় মজুরি ধার্য হয় ৬৫ টাকা। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫ টাকা। ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা-বাগানগুলিতে একজন শ্রমিক আটঘণ্টা কাজ করে পাবে ১১৫ টাকা। পরের প্রতি বছরে বাড়বে ১১ টাকা হারে। বরাকে মজুরি নির্ধারণের সভা এ মাসেই হবে বলে জানা গিয়েছে।

Advertisement

সমান কাজ করে কম মজুরির পাওয়ার এই ঘটনায় বরাকের চা শ্রমিকদের প্রায়ই আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেয়। তবে পেটের দায়েই শ্রমিকদের পক্ষে সেই আন্দোলনকে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি প্রতিটি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। কিন্তু বিশেষ কিছু করতে পারেনি। বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়ন মজুরি নির্ধারণ-সহ শ্রমিক সংশ্লিষ্ট সমস্ত সরকারি বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করে। ইউনিয়নের সহকারী সাধারণ সম্পাদক দীননাথ বারুই বলেন, আগামী তিন বছরের মজুরি স্থির করতে ক’দিনের মধ্যে মালিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠক হবে। এর আগেই টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন-কে চিঠি পাঠিয়ে সম-মজুরির কথা আমরা জানিয়ে দিয়েছি। এ বার চেপে ধরব। এই দাবি যে একবারে মিটে যাবে, এমন আশা করেন না দীননাথবাবুও। তবে ব্যবধানটা ধীরে ধীরে হলেও কমিয়ে আনাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।

বৈঠকে যাই হোক বাইরে বিরোধিতায় যান না চা উৎপাদকরাও। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সচিব কল্যাণ মিত্র বলেন, মজুরিটা কখনও একক ভাবে ঠিক হয় না। আলোচনাতেই মজুরি স্থির হয়, বৃদ্ধির হারও তখনই চূড়ান্ত হয়। সংস্থার সহকারী সচিব শরদিন্দু ভট্টাচার্যের কথায়, কোনও এলাকার চায়ের হেক্টর-প্রতি উৎপাদন, শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা, তাদের মাথাপিছু উৎপাদন, বাগানের আয়---ইত্যাদি সব বিষয় মাথায় রেখে মজুরি স্থির করা হয়। দুই উপত্যকার চায়ের দরেও বড় ফারাক রয়েছে। নিলামের বাজারে অসম চা ও বরাক চা পৃথকভাবে চিহ্নিত হয়। দামে কেজি প্রতি ফারাক ২০ থেকে ২৫ টাকা। সে জন্যই বিভিন্ন কমিশন এবং সরকার মজুরি বৈষম্য মেনে নিচ্ছে।

২০১৬ সালে অসমে বিধানসভা ভোট। তার আগে কী ভাবনা তরুণ গগৈ সরকারের?

১৯৪৮ সালের ন্যূনতম মজুরি আইন এ দেশে চালু রয়েছে। এর ৫(এ)(১) ধারা অনুসারে ১৯৫০ সালে বাগান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। সভাপতি ছিলেন পি চেতিয়া। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতেই ১৯৫২ সালে মজুরি ব্যবধানে সরকারি স্বীকৃতি মেলে। চেতিয়াও পুরো দায় নিজের কাঁধে নিতে চাননি। তাঁর আগে তৈরি হয়েছিল দেশপাণ্ডে রিপোর্ট। দেশপাণ্ডে রিপোর্টে বলা হয়: কাছাড়ে (এখন তা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় বিভক্ত) একই কাজ আদায়ে বেশি শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চেয়ে তাদের মাথাপিছু উৎপাদন ক্ষমতা কম। তা তাদের মজুরিতেও প্রভাব ফেলে। তাই কাছাড়ের বাগানগুলিকে টিঁকিয়ে রাখতে হলে মজুরি ব্যবধানকেও টিঁকিয়ে রাখতে হবে। দেশপাণ্ডে কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে চেতিয়া সহমত পোষণ করেন। ১৯৮৯ সালে অসমের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব হরেন্দ্রকুমার দাসকে শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়। ১৯৯০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করেন। সেখানেও এই মজুরি-ব্যবধান বজায় রাখার সুপারিশ করা হয়।

বিধানসভার অধিবেশনে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রাতাবাড়ি আসনের কংগ্রেস বিধায়ক কৃপানাথ মালা। উত্তরে মন্ত্রী এটোয়া মুন্ডা জানান, হেক্টর প্রতি চায়ের উৎপাদন, পরিবহণ সমস্যা, মাটির গুণগত মান, চায়ের মানের প্রেক্ষিতে নিলাম বাজারে মূল্যপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয় বিচার করে এত কাল দুই উপত্যকায় দুই ধরনের মজুরি চলে আসছে। বিভিন্ন কমিটিও এই ব্যবধান বজায় রাখার পক্ষেই

সুপারিশ করে। মুন্ডা জানান, তবে সরকার এখন মনে করছেন, কোনও এলাকার উৎপাদন ক্ষমতা বা লাভের মাত্রা দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি স্থির হতে পারে না। এ ছাড়া, অন্য কোনও ক্ষেত্রে যখন দুই উপত্যকার মজুরিতে ফারাক নেই, তখন চা শিল্পেও তা না-থাকাই বাঞ্ছনীয়। বরাক উপত্যকায় চা শ্রমিকদের মজুরি যে অত্যন্ত কম, তা স্বীকার করে নিয়ে মন্ত্রী বলেন, সরকার এরই মধ্যে নতুন মজুরি নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মুখ্যসচিবকে চেয়ারম্যান করে মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাডভাইজরি বোর্ড গঠন করা হয়েচে। এ বার বরাকের চা শ্রমিকদের মজুরি-বৈষম্যের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে বলেই মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত, বরাক উপত্যকার তিন জেলায় মোট ১১০টি চা বাগান রয়েছে। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন