চার বছর আগের দিল্লির জামা মসজিদের সামনে গুলি চালনা ও বারাণসী বিস্ফোরণ। ২০১১-য় মুম্বই আর ২০১২-র পুণের বিস্ফোরণ। তার পর গত বছর হায়দরাবাদের দিলসুখনগর, বিহারের বোধগয়া ও পটনায় নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় বোমা হামলা। পুলিশের দাবি, এই সব ক’টি নাশকতার যোগসূত্রই এক পাকিস্তানি জঙ্গি। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য ওয়াকাস ওরফে জিয়াউর রহমান।
বোমা বানাতে সিদ্ধহস্ত সেই ওয়াকাসকে রাজস্থান থেকে গ্রেফতার করল পুলিশ। পাকড়াও হয়েছে তার তিন সঙ্গীও। দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেলের দাবি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের এই দলটি লোকসভা ভোটের সময়ে বড়সড় হামলার ছক কষছিল। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনী সভা তো বটেই, বিদেশি পর্যটকদের নিশানা করার জন্য রাজস্থানের পুষ্করের মতো পর্যটন কেন্দ্র ও রয়্যাল এক্সপ্রেসের মতো বিলাসবহুল ট্রেনেও হামলার পরিকল্পনা ছিল। ওয়াকাসের সঙ্গীদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল বিস্ফোরক, ডিটোনেটর, টাইমার ও অন্যান্য নাশকতার সরঞ্জাম আটক করা হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই নরেন্দ্র মোদীর উপরে হামলার আশঙ্কা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব সরব। ওয়াকাসরা মোদীকেও নিশানা করেছিল কি না, তা নিয়ে অবশ্য পুলিশ-কর্তারা মুখ খুলতে চাননি।
ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের পাণ্ডা ইয়াসিন ভটকলকে গ্রেফতারের পরেই ইঙ্গিত মিলেছিল, লোকসভা ভোটের মরসুমে বড়সড় হামলার ছক কষছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। পটনায় নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় বিস্ফোরণের পর সেই আশঙ্কা সত্যি হয়। মুজাহিদিনের এই নাশকতার চক্রান্ত রুখতেই ওয়াকাসকে খুঁজছিলেন গোয়েন্দারা। কারণ ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নাশকতার জন্য বোমা বা আইইডি (ইমপ্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরির কাজ করত এই ওয়াকাস। হায়দরাবাদের দিলসুখনগরে বিস্ফোরণ স্থলে সিসিটিভি ফুটেজে ওয়াকাসের ছবিও মেলে। কিন্তু বার বারই গোয়েন্দাদের জাল কেটে পালিয়ে যাচ্ছিল ওয়াকাস। গত বছর অগস্টে বিহার থেকে ভটকল ও তার ডান হাত আসাদুল্লা আখতার ওরফে হাড্ডিকে গ্রেফতারের পর তাদের ম্যাঙ্গালোরের ডেরার খোঁজ পায় পুলিশ। কিন্তু সেখানে হানা দিয়ে ওয়াকাসের তৈরি ৯০টি আইইডি-র সন্ধান মিললেও ওয়াকাসের টিকি মেলেনি। শেষ পর্যন্ত শনিবার ভোরে রাজস্থান থেকে এই জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল। যাকে বড় সাফল্য বলেই আখ্যা দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
দিল্লি পুলিশের কর্তারা জানাচ্ছেন, শনিবার ভোরে মুম্বইয়ের বান্দ্রা থেকে ট্রেনে চড়ে অজমেরে এসে পৌঁছয় ওয়াকাস। সেখানেই তাকে আটক করা হয়। তাকে জেরা করে আজ জয়পুর ও জোধপুর থেকে তার তিন সঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। স্পেশ্যাল কমিশনার (স্পেশ্যাল সেল) এস এন শ্রীবাস্তব জানান, “ওয়াকাসের বয়স মাত্র ২৪ বছর। রাজস্থানে হামলার ছক চূড়ান্ত করতেই সে অজমেরে পৌঁছেছিল। এর আগে ইয়াসিন ভটকলের নির্দেশেই সে জামা মসজিদ, মুম্বই, পুণে ও হায়দরাবাদের নাশকতায় হাত মিলিয়েছিল।” অন্যান্য ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গির সঙ্গে ওয়াকাসের পার্থক্য সে পাকিস্তানের নাগরিক। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ফুড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমাধারী ওয়াকাস পাকিস্তানেই লস্কর-ই-তইবার জঙ্গি শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের প্রতিষ্ঠাতা ভটকল-ভাইদের সঙ্গে করাচিতেই তার আলাপ হয়। ২০১০ সালে প্রথম কাঠমান্ডু হয়ে ভারতে আসে ওয়াকাস। মুজাহিদিন-পাণ্ডা রিয়াজ ভটকল তাকে ও আসাদুল্লা আখতারকে ম্যাঙ্গালোরে একটা আস্তানা খুঁজে গা ঢাকা দিয়ে থাকার নির্দেশ দেয়। সেখান থেকেই রিয়াজের পাঠানো বিস্ফোরক নিয়ে বোমা তৈরি করত ওয়াকাস। হাওয়ালার মাধ্যমে আসত টাকা। এই বোমা দিয়েই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হায়দরাবাদের দিলসুখনগরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পরে ইয়াসিন ভটকলের সঙ্গে আসাদুল্লা ধরা পড়লেও ওয়াকাস পুলিশের চোখে ধুলো দেয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বোমা বানানোর কাজে মূলত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটই বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করত ওয়াকাস। পরে সে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে। ২০১০ সালের বারাণসী বিস্ফোরণে এই বোমা কাজে লাগানো হয়। দিল্লিতে ইজরায়েলি দূতাবাসের গাড়িতে হামলায় ব্যবহৃত ‘চুম্বক বোমা’ তৈরির চেষ্টাও ইদানিং করছিল সে। তার অন্য তিন সঙ্গীর মধ্যে এক জন ইঞ্জিনিয়ার। অন্য জন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। আর এক জন কম্পিউটার ডিজাইনার। ওয়াকাসই তাদের হাতে ধরে বোমা তৈরি শেখাচ্ছিল। পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, ওয়াকাসের মুখে সামান্য প্যারালিসিস রয়েছে। তার ফলেই তাকে চিনে ফেলা সহজ হয়েছে।
দিল্লি পুলিশ তথা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা মনে করছেন, ওয়াকাসদের জেরা করে রাজস্থান ছাড়া দিল্লিতেও ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নাশকতার ছক সম্পর্কে তথ্য মিলতে পারে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, দিল্লির আশেপাশের রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক রাজধানীতে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। রাজধানীতে নির্বাচন সংক্রান্ত বড় জমায়েত বা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের জনসভায় হামলা হতে পারে। ওয়াকাসদের গ্রেফতারের পর দিল্লির সীমান্ত এলাকায় কড়া নজরদারি শুরু হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা বা রাজস্থান থেকে দিল্লিতে ঢোকার রাস্তায় ব্যারিকেড বসিয়েছে পুলিশ। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-র কর্তাদের কথায়, রাজস্থানে বহু দিন ধরেই জাল বিছানোর কাজ করছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। ইয়াসিন ভটকলের আর এক সঙ্গী তেহসিন আখতার ওরফে মনু গত বছর জয়পুর ও জোধপুরে গিয়েছিল। সেখানে সংগঠন তৈরির চেষ্টা করে সে। এ কথা জানার পরেই রাজস্থানের ওই শহরগুলিতে তেহসিন আখতার ও ওয়াকাসদের ছবি-সহ পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। ওয়াকাসকে জেরা করে এখন তেহসিন আখতারের খোঁজ পাওয়ারও চেষ্টা করবেন গোয়েন্দারা।