‘পরান যায় জ্বলিয়া রে, পরান যায় জ্বলিয়া’। প্রেমের দহনে নয়, গরমে। এপ্রিল মাস ফুরোতে দিন তিন চার বাকি, এই লেখা নিয়ে বসেছি। মাথার ওপর বনবন করে ঘুরছে পাখা। তবু শরীর বেয়ে কুলকুল করে বইছে স্বেদতরঙ্গিনী। নাঃ, মনে হচ্ছে এ বার এ সি আনতেই হবে। এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে যাতে বিদ্যুৎ খরচটি নিয়ন্ত্রণে থাকে সে কথা চিন্তা করেই যন্ত্রটি ঘরমুখো করিনি। তা ছাড়া গরম সহ্য করা— সহিষ্ণুতারও এক পরীক্ষা বটে। কত দিন মনকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছি, যাও না, দেখ না গিয়ে গরম কালে বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগঢ়—কী করে এই সব অঞ্চলের গরিব-গুরবো লোক সহ্য করে অমন কালান্তক গরম আর তুমি এই সাগরপাড়ে সদ্য সূর্য ডোবার সায়াহ্নে ঝুলবারান্দায় বসে ফুরফুরে হাওয়ায় মেজাজকে শরিফ করে তুলছ আর ভাবছ রাত্তিরে ভাল ঘুমোতে হলে ওই শীততাপ যন্ত্রটি না হলেই নয়। আজকাল অনেক মধ্যবিত্ত সংসারেই এ সি অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। পকেটে দু’পয়সা যখন আছে, তখন ‘আরাম হারাম হ্যায়’ এই আপ্তবাক্যটিকে উড়িয়ে দিয়ে এই ভোগসর্বস্ব জীবনটার জন্য কিনেই ফেলা যাক একখানা যন্ত্র। আর বিদ্যুৎ খরচ— সে তো মোটে এই গরমের দুটো মাস। সে যা হোক করে চালিয়ে নেওয়া যাবে ’খন।
আমাদের ছোটবেলায় এ সব কুলার বা এসি-র বালাই ছিল না। গ্রীষ্মকালে গরম যে কম পড়ত, তা তো নয়। তবে সে গরম রুখবারও সে সময় ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল, আর ছিল অঢেল গাছপালা, যারা গরম কিছু কমাত তো বটেই। (এখন সে সব গাছগাছালি কেটে সাফ, তাই গরম আটকানোর কেউ নেই)। হ্যাঁ, যা বলছিলুম, আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি সন্ধেবেলায় বালতি করে জল নিয়ে ঢেলে দেওয়া হত ছাদে। তার পর সে জল শুকোলে মাদুর কি শতরঞ্চি পেতে বসে হ্যারিকেন জ্বেলে পড়াশোনা কি গল্পগাছা। আর রাত্তির হলে ছেলেপুলের দল ছাদে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ত। মাথার ওপর ছাদ হল গিয়ে খোলা আকাশ। আর তাতে অজস্র তারার আলপনা। আজকাল বাচ্চাদের ঘরের ভিতর ছাদে কৃত্রিম উপায়ে ‘চাঁদ তারা’র চাঁদোয়া বানানো হয়। রাতে অন্ধকারে সেগুলো জ্বলজ্বল করে। মনে মনে ভাবি, হায়, এদের জীবনে সব থেকেও কিছুই নেই। নেই তারাভরা খোলা আকাশ, নেই আদিগন্ত সবুজ মাঠ, নেই পাখিদের কলকাকলি, নেই সবুজ পাতার নাচ। হ্যাঁ, আছে বাক্সের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি, আছে কৃত্রিম ভাবে সাজানো ঘর, আছে ভিডিওগেম, আছে টেলিভিশন, আছে ল্যাপটপ, আছে এসি মেশিন। একা একা থাকতে হয় তো, তাই এ সব গ্যাজেট এদের কাছে খুব জরুরি।
যাক সে সব কথা। বলছিলুম গরম নিয়ে। এই গরমে প্রাণ জুড়ানোর জন্য শরবতের জুড়ি মেলা ভার। আমাদের বঙ্গদেশের বিশেষত্ব হল গিয়ে বেলের পানা, আমপোড়ার শরবত, ঘোল। আর এই পশ্চিম মুলুকে ছাস। এই প্রচণ্ড রুখাশুখা গরমে ছাসের যা রমরমা, তাতে সে আর সবাইকে পিছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে যায়। এই দেখুন গরমে গলদঘর্ম হয়ে লিখতে লিখতে শরবতের কথা মনে হতেই প্রাণটা কেমন তেষ্টায় আইঢাই করে উঠল। আহা, হা, মানসচক্ষে যেন দেখতে পাচ্ছি শরবতের মেলা বসে গিয়েছে। কত রকমারি সব শরবত। থরে থরে সাজানো কাচের সুদৃশ্য গেলাসে, মাটির ছোট ছোট কলসিতে বেলের পানা, মিছরির পানা, নিম্বু-পানি, আমপোড়ার শরবত, তরমুজের রস, আমরস, আখের রস, লস্যি, নানা রকমের স্কোয়াশ—কমলালেবু, আনারস, আঙুর, নানা রঙের সিরাপ— কী যে নেই তা তো ঠাহর হল না। হঠাৎ মনে হল একজনকে যেন দেখতে পেলাম না। সে বোধহয় আমার মনের কথাটি পড়তে পারল। ওই শরবতের দঙ্গল থেকে আওয়াজ এল, এই যে আমি এখানে। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি, ও, এই তো তিনি বসে আছেন সকলের মধ্যমণি হয়ে। হ্যাঁ, একেই তো খুঁজছিলুম—আমাদের এই রুখাশুখা পশ্চিম মুলুকের একমেবাদ্বিতীয়ম ঠান্ডা শরবত— ছাস।
তা, হ্যাঁগা তুমি এই পাঁচ জনের ভিড়ে অমন মুখ লুকিয়ে বসে আছ কেন? প্রশ্ন করলুম আমি।
শরবতের ভিড় থেকে কে একটা কথা কয়ে উঠল, সত্যিকারের গুণিজনেরা অমন ভিড়ে মিশেই থাকেন, নিজেকে জাহির করেন না। জানেন কি এই রুখাশুখা মুলুকে উনি কেবল শরীর ঠাণ্ডাই করেন না, হজমেও সাহায্য করেন আবার রক্তে যাদের চিনি তারাও এটা নির্বিঘ্নে পান করতে পারেন, কারণ এতে চিনি টিনি থাকে না।
মনে মনে ভাবলুম, এই মরাঠা মুলুকে রয়েছি— ছাস খাইনি তা নয়, যদিও ছাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় গুজরাতের দ্বারকায় গিয়ে। গুজরাতি থালির সঙ্গে এক গেলাস ছাস—আহা হা প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়। একবার যদি খোদ ছাসের মুখ থেকেই ছাস বানানোর প্রণালীটা শিখে নেওয়া যায়। মনের ইচ্ছেটা বলেই ফেললুম ছাসকে।
ছাস কেমন লাজুক লাজুক মুখ করে বললে, আমাকে বানানো, সে আর এমনকী। ভারি সহজ।
তার পর সে যা বলল তার সারসংক্ষেপ হল এই যে প্রথমে দু’কাপ ফেটানো টক দইয়ে এক চামচ জিড়েগুঁড়ো, আধা চামচ আদা-কাচালংকা বাটা, এক চিমটে নুন, এক চিমটে বিটনুন দিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে নিতে হবে। তার পর এতে চার কাপ ঠাণ্ডা জল দিয়ে আবার ভাল করে ফেটাতে হবে। এ বার একটা ছোট্ট কড়াইয়ে এক চামচ সাদা তেল গরম করে সামান্য জিরে, এক চিমটে হিং দিয়ে সেটি ঢেলে দিতে হবে ওই বানানো শরবতে। এ বার ওপরে কিছু ধনেপাতা ছড়িয়ে দিলেই ছাস প্রস্তুত। আভি পি লে।
প্রণালীটি বর্ণনা করে সে আবার চুপি চুপি আমায় বললে, এই বিশেষ গুজরাতি প্রণালী কিন্তু রন্ধন বিশেষজ্ঞ তরলা দালালের। তুমি যেন আবার খোদার উপর খোদকারি করতে যেও না। তা হলেই বারোটা বাজবে। বাঙালি রসনায় এত খাট্টা সইবে না বলে যেন আবার চিনি মিশিও না।
বালাই ষাট, ও সব করতে যাব কেন। এই পশ্চিম মুলুকে এখানকার নিয়মই তো মেনে চলতে হবে বলছি আর এ দিকে তো আমার নোলা সকসক করে উঠছে। একটু পান করেই দেখি না কেন। ইচ্ছেটি প্রকাশ করতেই মাটির ছোট্ট সুদৃশ্য কলসি টইটুম্বুর ছাস চলকে পড়ল। কলসির কানায় সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছি—একটু স্বাদ নিয়েছি কি নিইনি অমনি হাত ফসকে মাটিতে পড়ে কলসি চুরমার।
চটকা ভাঙল আমার। ও হো, এই দেখেছেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঘামে জামাটামা ভিজে সপসপ করছে। মাথার ওপর তাকিয়ে দেখি পাখার ঘুর্ণন বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই। নাঃ, এ বার দেখছি সত্যিই এক গেলাস ছাস বানিয়ে খেতে হবে। পদ্ধতিটা তো শিখেই নিয়েছি। শরীর এবং মাথা দুটোই ‘কুল’ রাখতে হবে তো!
ছাস পর্ব সমাধা হল। এ বার দেখা যাক এই গরমে মুম্বইকরেরা কি পেলেন? পেয়েছেন, পেয়েছেন—একটা আস্ত রাস্তা পেয়ে গেছেন। নাম হল গিয়ে সান্তাক্রুজ-চেম্বুর লিংক রোড। সংক্ষেপে এস সি এল আর। মুম্বইয়ের পূর্ব ও পশ্চিম শহরতলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই রাস্তা। সান্তাক্রুজের ভাকোলায় ওয়েস্টার্ন হাইওয়ের সঙ্গে চেম্বুরের অমর মহল জংশনে ইস্টার্ন হাইওয়েকে জুড়ে দিয়েছে এই এস সি এল আর। প্রায় এগারো বছর ধরে তৈরি এই রাস্তাটি সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাটি চেম্বুর থেকে ভায়া কালিনা, কুরলা, তিলকনগর হয়ে সান্তাক্রুজ পৌঁছেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬.৪৫ কিলোমিটার। এই রাস্তার ওপরেই রয়েছে ১.৮ কিলোমিটার ডাবল ডেকার ফ্লাইওভার যা সেন্ট্রাল ও হার্বাল লাইন রেলওয়ে ট্রাকের ওপর দিয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ফ্লাইওভারটি ভারতে সর্ব প্রথম ডাবল ডেকার ফ্লাইওভার। এই ছয় লেনের রাস্তাটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় চারশো চুয়ান্ন কোটি টাকা। প্রথমে এর ব্যয়ভার বহন করছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক— মুম্বই আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট হিসেবে। পরবর্তী কালে অস্বাভাবিক দেরির জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক অর্থসাহায্য বন্ধ করে দিলে বাকি অংশ মুম্বই মেট্রোপলিটান রিজিওন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নিজস্ব অর্থ দিয়ে শেষ করে। রাস্তাটির ওপর গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ধার্য করা হয়েছে ঘণ্টায় তিরিশ কিলোমিটার। রাস্তায় ভারী গাড়ি, বাইসাইকেল, ট্রাইসাইকেল, প্রতিবন্ধীদের ট্রাইসাইকেল, হাতে ঠেলা গাড়ি, পশুচালিত গাড়ি ও হাঁটাচলা নিষিদ্ধ। যাত্রিবাহী বাস অবশ্য চলতে পারে। এই রাস্তা নির্মাণের ফলে এক ঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ এখন ১৫-২০ মিনিটেই চলে যাওয়া যাচ্ছে। ট্র্যাফিকের ভিড়, খরচ এবং সময় বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে এই এস সি এল আর-এর মাধ্যমে। এই রাস্তা নির্মাণের ফলে পুণে, গোয়া বা নাসিক যাওয়ারও সুবিধা হবে।
সুযোগ এসেছিল এস সি এল আর-এর ওপর দিয়ে যাওয়ার। সান্তাক্রুজে এক দাদার বাড়ি আতিথেয়তা রক্ষা করতে গিয়ে যাওয়া-আসায় এই রাস্তাটিই নেওয়া হয়েছিল। এই গরমে যাতায়াতে কিছুটা সময় তো বাঁচল।
বৈশাখ শেষ হতে চলল। জ্যৈষ্ঠ এল বলে। এই সময়টা একটি জিনিসের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি। কী বলুন তো? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আম্রফল— আম মশাই আম। এই একটি ফলই বোধহয় গ্রীষ্মকে জাতে তুলে দিয়েছে।
শীতকালে তো আম পাবেন না। এখানে বাংলার হিমসাগর বা মালদার ফজলি পাই না বটে তবে হাপুস, বাদামি, কেশর, ল্যাংড়া দসেরি এ সব ভালই মেলে। প্রথম দিকে হাপুস মানে আলফানসোর দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও শেষের দিকে তা কিছুটা পড়তে থাকে। এ বার তো ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার কারণে রফতানি করা যাবে না বলে আলফানসোর দাম অনেকটাই কম থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তা হিমসাগর যখন মিলবেই না, তখন এ সব আমেই পেট ভরাই। বছরে এই একটা সময়ই তো দেখা মেলে ফলের রাজার। এ বারে এখনও পর্যন্ত হাপুস, বাদামি আর লালবাগ আম খেয়েছি। তবে আরও কটা দিন গেলে আমে রসে আরও জমবে। আমের সময় এলে ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। পাকা টুসটুসে আমের পিছনে ফুটো করে খোসা চিপে চিপে রস খাওয়া— কনুই বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে রসের ধারা। আম কাটার বালাই ছিল না। এ ভাবেই খাঁটি দিশি পদ্ধতিতে একের পর এক সাবাড় হয়ে যেত হিমসাগর, মিঠুয়া। এ সব মনে পড়লে ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছেপূরণের দেবীকে কোথায় পাব বলতে পারেন? লেখা গড়িয়ে চলেছে। কিন্তু আর একে গড়াতে দেওয়া যায় না। এ বারে দাঁড়ি টানার পালা। এই গরমে সবাই সুস্থ থাকুন। নিম্বু-পানি, ছাস পান করুন। শরীরটা ফিট রাখতে হবে তো, বিশেষ করে এই মুম্বইয়ে যেখানে কাজের চাকা অবিরাম ঘুরছে।