পুনর্বাসনের সুবিধে পাবে ধৃত মাওবাদীও, বিতর্কে নয়া নীতি

আত্মসমর্পণ করা মাওবাদীদের সংজ্ঞাটাই এ বার বদলে দিতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর বিধানসভা ভোটের মুখে মাওবাদীদের ‘আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতি’-তে বদল আনার পর সরকারের অন্দরে তৈরি হয়েছে বিতর্কও।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৬
Share:

আত্মসমর্পণ করা মাওবাদীদের সংজ্ঞাটাই এ বার বদলে দিতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর বিধানসভা ভোটের মুখে মাওবাদীদের ‘আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতি’-তে বদল আনার পর সরকারের অন্দরে তৈরি হয়েছে বিতর্কও।

Advertisement

নতুন নীতিতে, মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে অতীতে ধৃত ও বর্তমানে জামিনে মুক্ত কোনও ব্যক্তিও এ বার সরকারি পুনর্বাসন প্যাকেজের সুবিধে পেতে পারেন। যা এত দিন শুধুই ছিল আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের জন্য।

আবার কোনও ফৌজদারি মামলা পুলিশের খাতায় নেই, কিন্তু অতীতে মাওবাদী কার্যকলাপে কোনও ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, এমন লোকজনকেও পুনর্বাসন প্যাকেজের আওতায় আনা হবে। অথচ এত দিন মাওবাদী বলে মূলত তাঁদেরই গণ্য করা হত, যাঁদের নাম পুলিশের খাতায় আছে মাওবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত হিসেবে।

Advertisement

গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর ওই বিজ্ঞপ্তি (No.206-PL/HP/BMC/SRE-12/13) জারি করেছে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, এই বিজ্ঞপ্তির ফলে জঙ্গলমহলের বহু মানুষের কাছে সরকারি সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার পথ খুলে গিয়েছে। বিধানসভা ভোটের মাস ছয়েক আগে এই নতুন নীতি আখেরে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে কিছু লোককে পাইয়ে দেওয়ার কথা মাথায় রেখে তৈরি বলে মনে করছেন ওই অফিসাররা। ঠিক যেমন দু’লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের বহু ক্লাবকে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সতর্ক ভাবে বিচার-বিবেচনা করার পর মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতির আওতায় এ বার সেই অতি বাম চরমপন্থীদের আনা হচ্ছে, ক) যাঁরা এক সময়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং এখন জামিনে মুক্ত ও খ) যাঁরা একটা সময়ে সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি মামলা নথিবদ্ধ নেই।’ পুনর্বাসন প্যাকেজের সুবিধে এঁদের দেওয়া হবে, ‘যাতে তাঁরা হিংসার পথে আর ফিরে না যান।’

এই যুক্তি মানলেও গোয়েন্দাদের একাংশের পাল্টা যুক্তি, লালগড় আন্দোলনে মাওবাদী প্রভাবিত পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির মিছিলে হেঁটেছেন, এমন লোকজনও এ বার পুনর্বাসনের আর্থিক সুবিধে পেয়ে যেতে পারেন!

স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি সূত্রের খবর, নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক দুলাল মুর্মু গত ২৬ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে গোপীবল্লভপুর এলাকার ১৭ জনের নামের তালিকা দিয়ে জানান, এঁরা সকলেই ২০১১-র আগে মাওবাদী পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে রাজ্যে পালা বদলের পর ‘নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে’ তাঁরা মাওবাদীদের সংস্রব ত্যাগ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তাঁরা প্রচণ্ড দারিদ্রে আছেন বলে তাঁদের জন্য পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন দুলালবাবু।

অথচ স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি সূত্রের খবর, ওই ১৭ জনই বাড়িতে আছেন এবং তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা নেই। তা হলে তাঁদের জন্য পুনর্বাসন চাওয়ার অর্থ কী, পুলিশের একাংশের কাছে তা বোধগম্য নয়। দুলালবাবুও স্বীকার করছেন, ‘‘ওরা সকলেই এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। তবে ওদের কয়েক জন ওড়িশায় মাওবাদী হিসেবে জেল খেটেছে। এর বেশি কিছু বলব না।’’ গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই ১৭ জনের প্রায় সকলেই এখন শাসক দলের সক্রিয় কর্মী।

স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশও অন্য ২২ জনের নামের একটি তালিকা তৈরি করে তাঁদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ চেয়েছে। ঝাড়গ্রাম ও আশপাশের তল্লাটের বাসিন্দা ওই ২২ জনের সকলেই নিজেদের বাড়িতে আছেন কয়েক বছর ও তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা নেই। এমনটাই গোয়েন্দাদের একাংশের।

এই ধরনের লোকদের আর্থিক সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে বাধা না থাকে, সেই জন্য আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতিতে বদল আনা হল বলে পুলি‌শ-প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ মনে করছেন।

জঙ্গলমহলে কর্মরত এক আইপিএস অফিসারের মতে, ‘‘মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করানোটা আমাদের তাগিদ। নেতা, স্কোয়াড সদস্য কিংবা নাশকতার ঘটনায় অভিযুক্তদেরই আত্মসমর্পণ করানোর তাগিদ থাকে আমাদের। সেই কথা ভেবেই পুনর্বাসনের প্যাকেজ। নতুন নীতির ফলে এমন অনেকে সুবিধে পাবে, যাদের আত্মসমর্পণ করানোর তাগিদ আমাদের তেমন নেই।’’

২০১০-এর জুলাইয়ে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের জন্য প্রথম আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নীতি ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। তখন বামফ্রন্টের জমানা। ২০১১-তে ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যায়ক্রমে ওই সুবিধের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। নবান্ন সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত ৪৩ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রত্যেককেই স্পেশ্যাল হোমগার্ড পদে নিয়োগ করা হয়েছে। মাসোহারা চার হাজার টাকা। আত্মসমর্পণ করার সময়ে এক-এক জনকে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।

প্রত্যেক আত্মসমর্পণকারী ও সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের নামে যৌথ ভাবে ২ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে জমা থাকছে স্থায়ী আমানত হিসেবে। যা তিন বছর পরে মূলস্রোতে ফেরা ওই মাওবাদী তুলে নিতে পারবেন তাঁর ভাল ব্যবহারের সাপেক্ষে এবং এই মর্মে শংসাপত্র পেয়ে। আবার আত্মসমর্পণের সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র, ল্যান্ডমাইন বা বিস্ফোরক জমা দিলে সেই জন্যও এসপি এবং ওই মাওবাদীর নামে যৌথ ভাবে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানত হিসেবে টাকা থাকছে। টাকার অঙ্ক এক-এক রকম অস্ত্র ও বিস্ফোরকের জন্য এক-এক রকম।

সেই সঙ্গে বাড়িভাড়া বাবদ মাসে আড়াই হাজার টাকা, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য চিকিৎসার খরচ বাবদ মাসে সর্বাধিক আড়াই হাজার টাকা, সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে ওষুধ, সন্তানদের প্রত্যেকের পড়ার খরচ বাবদ মাসে ৫০০ টাকা উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত ও কলেজে গেলে দেড় হাজার টাকা সরকার দিচ্ছে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের। তাঁদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার খরচ বহনের ব্যাপারেও সরকার বিবেচনা করবে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক মাওবাদী কিংবা তাঁকে আত্মসমর্পণ করানোয় ইচ্ছুক পুলিশ কোনও মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নির্দিষ্ট দিনে ওই মাওবাদী ধরা দেন। পুলিশের নিরাপদ আশ্রয়ে কিছু দিন থাকার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে এক দিন আত্মসমর্পণ দেখানো হয়।

এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘এ বার তো আর এত ঝক্কি নেওয়ার দরকার নেই। কবে কোন দিন মিছিলে হেঁটেছিল বা মাওবাদীদের খাবার দিয়েছিল, বাড়িতে কয়েক বছর ধরে শান্তিতে বসে থাকা এমন লোকও এ বার পুনর্বাসন প্যাকেজ পাবে।’’

মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষকর্তা, ‘‘তালিকা যিনিই পাঠান, কাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে, সেটা কিন্তু শেষ বিচারে ঠিক করবে স্ক্রিনিং-কাম-রিহ্যাবিলিটেশন কমিটি। সেখানে রাজ্য পুলিশ ছাড়া সিআরপি, এসআইবি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। অতীতে বহু নাম ওই কমিটি বাতিল করেছে।’’ তবে ওই কর্তা মানছেন, ‘‘আগে ১০ জনের তালিকা বিবেচনার জন্য কমিটির কাছে পাঠালে এখন সেখানে হয়তো ৩০ জনের নাম আসবে।’’

সেই সঙ্গে তাঁর যুক্তি, নাশকতায় অভিযুক্ত হিসেবে নাম নেই, স্কোয়াডেরও সদস্য নয়, কিন্তু এখন মাওবাদীদের লিঙ্কম্যান হিসেবে তাদের ভূমিকার কথা জানা যাচ্ছে, আবার তারা মূলস্রোতে ফিরতে চাইছে, এমন লোকদের কী হবে? তা ছাড়া, ধৃত অথচ জামিনে মুক্ত, এমন কয়েক জন মাওবাদী অত্যন্ত দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা চাই, আর সন্ত্রাস, হিংসা না ফিরুক। প্রাক্তন মাওবাদী বা তাদের সমর্থকেরা যাতে বিপথে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতেই পুনর্বাসন নীতি বদলানো হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন