নেই পাশ-ফেল। নেই বোর্ডের পরীক্ষা। তাতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে বলে দাবি সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন বা সিবিএসই-র।
ওই বোর্ডের কর্তৃপক্ষ বলছেন, নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়ায় এবং দশম শ্রেণিতে বোর্ডের পরীক্ষা আর বাধ্যতামূলক না-থাকায় তাঁদের পড়ুয়াদের মান ও উৎকর্ষ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কমেছে মানসিক চাপও। কিন্তু শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশের মতে, সিবিএসই স্কুলের সাফল্যের নিরিখে দেশের সব স্কুলে সামগ্রিক ভাবে এই পদ্ধতি চালু করা যাবে না। কারণ, হাতেগোনা এবং সচ্ছল সিবিএসই স্কুল যা করতে পারে, সর্বত্র তা চালু করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েই কপিল সিব্বল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সিবিএসই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল রাখা হবে না। বাধ্যতামূলক ভাবে দশম শ্রেণিতে বোর্ডের পরীক্ষাতেও বসতে হবে না। দেশের সব বোর্ডে এই ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হলেও সিবিএসই ছাড়া অন্য কোনও রাজ্য বোর্ড বা আইসিএসই-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাও এই বন্দোবস্ত মেনে নেয়নি। আগামী দিনেও এই ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা তাদের নেই বলে জানিয়েছে আইসিএসই কাউন্সিল।
সিবিএসই-র দশম শ্রেণিতে বোর্ডের পরীক্ষা তুলে দিয়ে সিসিই বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পড়ুয়াদের অগ্রগতি যাচাইয়ের ব্যবস্থা চালু হয়েছে বছর চারেক আগে। শুধু পাঠ্যক্রমের পড়া নয়, এতে ক্যুইজ, সাক্ষাৎকার, বিতর্ক, প্রজেক্ট, মৌখিক পরীক্ষার মতো বিষয়ও যুক্ত হয়।
সোমবার সিসিই সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্টে সিবিএসই-র চেয়ারম্যান বিনীত জোশী দাবি করেছেন, “সিবিএসই স্কুলগুলির ৯৯% প্রধান শিক্ষক এবং ৯৬% শিক্ষক এই নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন।” যদিও সিবিএসই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কেউ কেউ মনে করেন, এই ব্যবস্থায় আড়ম্বর বেশি। ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান আহরণের বিষয়টি এতে উপেক্ষিত।
শিক্ষার অধিকার আইনে এমনিতেই প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্র নবম-দশম পর্যন্ত সিবিএসই স্কুলে পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু সিবিএসই-র দাবি, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়ায় পড়ুয়ারা অনেক খোলা মনে পড়াশোনা করতে পারছে। সে জন্য দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে তাদের ফল ভাল হচ্ছে।
সাফল্যের দাবির সমর্থনে সংখ্যাতত্ত্বের সাক্ষ্যও টেনে এনেছেন সিবিএসই-র চেয়ারম্যান। তিনি জানান, ২০১০ সালে দশম শ্রেণিতে পাশের হার ছিল ৮৮.২৮%। ’১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৮.৭৬%। ওই বোর্ড সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, যে-সব ছাত্রছাত্রী দশমে বোর্ডের পরীক্ষা দেয়, তাদের তুলনায় সিসিই দিয়ে আসা পড়ুয়ারা দ্বাদশে বেশি ভাল ফল করে।
পাশ-ফেল তুলে দেওয়ায় পড়ুয়াদের মানসিক চাপও অনেক কমেছে বলে ওই বোর্ডের দাবি। সার্বিক ভাবে কমেছে আত্মহত্যার ঘটনা। সিবিএসই-র দাবি, ৬০% বাবা-মা এবং ৮২% পড়ুয়া নতুন ব্যবস্থায় খুশি। বিশেষত পড়ুয়াদের দাবি, পাশ-ফেলের চাপ না-থাকায় তাদের জানার আগ্রহ বেড়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী পল্লম রাজু বলেন, “নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষকদের উপরে চাপ বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু পড়ুয়াদের উপর গতানুগতিক পরীক্ষার বোঝা কমেছে।”
কলকাতার অন্যতম সিবিএসই স্কুল ভারতীয় বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষা অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় জানান, ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালু হওয়ায় পঠনপাঠনের পাশাপাশি পাঠ্যসূচি-বহির্ভূত বিষয়েও ছাত্রছাত্রীরা তৈরি হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক ভাবে তাদের উন্নয়নের সুযোগ অনেকটা বেড়েছে।
সিবিএসই-র পরীক্ষা পদ্ধতিই অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক বলে একে সমর্থন জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ মর্মর মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত যত কমিটি হয়েছে, তার প্রতিটিই ধারাবাহিক মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে। বোর্ডের পরীক্ষার থেকে এই পদ্ধতি অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক।” অনেক শিক্ষাবিদ অবশ্য এই পদ্ধতিকে স্বাগত জানাচ্ছেন না। বিভিন্ন বোর্ডের অধীন স্কুলের চরিত্রগত পার্থক্যই তাঁদের আপত্তির মূল কারণ। কলকাতা আইআইএমের শিক্ষক রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানান, সিবিএসই-র স্কুলগুলি কেন্দ্রীয় সাহায্য পায়। যে-সব বেসরকারি স্কুলে এই বোর্ডের পাঠ্যসূচি মেনে পড়াশোনা হয়, সেগুলোর পরিকাঠামো অত্যন্ত উন্নত। আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল ওই সব স্কুলে প্রত্যেক ছাত্র বা ছাত্রীর প্রতি আলাদা নজর দেওয়া অনেক সহজ। তাই ওই সব স্কুলের সাফল্যকে সামগ্রিক ভাবে দেখা ঠিক নয়।
একই মত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি স্কুল পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদারের। তিনি বলেন, “এই পদ্ধতি সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, শিক্ষার অধিকার আইনে গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা বিনা বেতনে যে-সব স্কুলে পড়াশোনা করতে আসে, সেখানে এত উন্নত মানের পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা বা এতটা মনোযোগের সঙ্গে প্রত্যেক পড়ুয়ার অগ্রগতির দিকে নজর রাখা সম্ভব নয়। তাই বোর্ডের পরীক্ষা অপরিহার্য। সেখানে ছাত্রছাত্রীর মেধার একটা গড় মূল্যায়ন অন্তত হয়।” বোর্ডের পরীক্ষা তুলে না-দিলেও এ রাজ্যে গত বছর থেকে সিসিই পদ্ধতি চালু হয়েছে।