সে দিন দু’জনে। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে ব্যবসায়ী সমিতির এক সভায় একই মঞ্চে নরেন্দ্র মোদী ও মুরলীমনোহর জোশী। —ফাইল চিত্র।
রবিবারের সকাল। গুলাববাগে বিজেপি-র প্রধান দফতর। দোতলা হলদে বাড়ি। কাছেই একটি বড় মসজিদ। দফতরের দেওয়ালে সাঁটা মুরলী মনোহর জোশীর বড় পোস্টার। রয়েছে অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর পোস্টারও। মোদীর খুব বড় কাটআউট বা ফ্লেক্স কিন্তু চোখে পড়ল না। ওই দফতরের সামনেই আজ বিক্ষোভ দেখিয়েছে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। বিজেপি-র ছাত্র-সংগঠনের দাবি, জোশী নয়, বারাণসীতে চাই মোদীকেই। তখন দফতরে বড় মাপের কোনও নেতা ছিলেন না। খবর পেয়ে ছুটে আসেন জেলা সভাপতি। প্রার্থী প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি, এই আশ্বাস দিয়ে শান্ত করেন বিক্ষোভকারীদের।
ভোটের মুখে ভারতের অন্যতম প্রাচীন এই শহর রাজনীতির ‘হট বেড।’ কাশী বিশ্বনাথের মন্দির থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট, গ্রেটার বারাণসী থেকে কোচবিহারের রাজবাড়ির কালীমন্দির, লাক্ষার রামকৃষ্ণ মিশন সর্বত্রই আলোচনা চলছে নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে। তাঁকেই চাইছেন সবাই। ক্রমেই জোরদার হচ্ছে জোশী হটাও আওয়াজ!
বারাণসী (দক্ষিণ)-এর বিজেপি বিধায়ক, বঙ্গসন্তান শ্যামদেব রায়চৌধুরীর ভাবমূর্তি স্বচ্ছ। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তিনি আর্জি জানিয়েছেন, জোশী নয়, মোদীকেই প্রার্থী করা হোক বারাণসী থেকে।
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো জোশীর বিরুদ্ধে টিহরি বাঁধ নিয়ে ময়দানে নেমেছেন গত বার এই আসনে বিএসপি-র হয়ে দাঁড়ানো মুখতার আনসারি। বিশ্বনাথ মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে দোতলায় সিপিএমের দফতর। সেখানেও নেতারা বলছেন, জোশী এ বারে দাঁড়ালে হেরে যাবেন।
একই সুর আম জনতার মুখে। যেমন, অটোরিক্সা চালক নরেশ বিশ্বকর্মা। কাঁধে সাদা-নীল ডুরে গামছা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তুলসি ঘাট থেকে কেদার ঘাটে আসার পথে বললেন, “গত পাঁচ বছরে জোশী কার্যত এখানে আসেনইনি! এই এলাকার জন্য কোনও কাজও করেননি। দেখছেন রাস্তা-ঘাটের অবস্থা!” যেমন, রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। সবে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁদেরও অনেকেই বলছেন, “জোশী এই এলাকার মানুষের জন্য কিছু করেননি। ইলাহাবাদে হেরে গিয়ে তিনি বারাণসী এসেছিলেন। বারাণসীতে বিজেপি-র দাপট দীর্ঘদিনের হলেও জোশী প্রার্থী হলে এ বার তাঁকে ভোট দেব না।”
দোল পূর্ণিমার আর এক সপ্তাহ বাকি। বারাণসীর অন্যতম গোধূলিয়া চক বাজারে হইহই করে বিকোচ্ছে মোদী পিচকিরি। দাম ছ’শো টাকা। রং গেরুয়া। মোদীর ছবির নীচে লেখা রয়েছে মোদী পিএম-২০১৪। বিজেপি-র সমর্থক বণিকসমাজ মোদীর ছবি লাগানো গুলাল-বোম বা আবির বোমাও বাজারে এনেছে। কংগ্রেস অফিসে বসে স্থানীয় নেতা মহম্মদ কাদির রেগেমেগে বললেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে যাব ভাবছি। দোলের বাজারে দোকানদারদের ব্যবহার করে বিজেপি রাজনীতি করছে।” যদিও দোলের বাজারে মোদীর চাহিদা দেখে কংগ্রেসও রাতারাতি রাহুল পিচকিরি এনে ফেলেছে! আয়ুর্বেদ আবিরের প্যাকেটেও রাহুলের ছবি। রাহুল আবির আর পিচকিরির দাম যথাক্রমে একশো ও দু’শো টাকা।
বারাণসী কেন্দ্রে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি বিজেপি-র দখলে। বাকি দু’টির মধ্যে একটি সমাজবাদী পার্টি ও অন্যটি আপনা দলের দখলে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, ক্ষমতায় দু’বছর থাকতে না থাকতেই সমাজবাদী পার্টির মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান। সাধারণ মানুষ তিতিবিরক্ত। রাত্রি ন’টার সময়ে বিশ্বনাথের গলিতে ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। দোকানদারেরা তারস্বরে গালাগালি দিতে শুরু করলেন অখিলেশকে! ঘিঞ্জি আবর্জনাময় শহরে যে শুধু জল-সড়ক বা গঙ্গার দূষণই সমস্যা, তা নয়। বিদ্যুৎ সমস্যাও এখন চরমে।
বারাণসীতে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি উল্লেখজনক। বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশেই জ্ঞানবাপী মসজিদের সামনে লম্বা লাইন। মুসলিম মহল্লাতেও অসন্তোষ অখিলেশ-মুলায়মের বিরুদ্ধে। এক মুসলিম ‘বেনারসি’ পানওয়ালা বললেন, “এর চেয়ে মায়াবতীই ভাল ছিলেন। চুরি হতো। কিন্তু তিনি উন্নতির জন্য টাকাও খরচ করতেন। আর প্রশাসনও এত দুর্বল ছিল না। মানুষ প্রশাসনকে ভয় পেত। এখন তো সরকার চালাচ্ছে অপরাধীরা!” সপা নেতারাও মেনে নিচ্ছেন পরিস্থিতি প্রতিকূল। তাঁদের বক্তব্য, “বেচারা অখিলেশ! শুধু বাবা নয়, কাকা-মামাদের হাতেও নিপীড়িত তিনি! আজম খান থেকে রামগোপাল যাদব সবাই তো সমান্তরাল মুখ্যমন্ত্রী! অখিলেশ রাজ্যটা চালাবেন কী করে!”
বারাণসীতে সঙ্ঘ পরিবারের পুরনো জনভিত্তি রয়েছে। সর্বভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্মেলন নামে একটি সংগঠন এখানে রয়েছে। স্থানীয় পণ্ডিত গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বরাবর বিজেপি-কে সমর্থন করে এসেছে। বৈদিক স্কুল-কলেজও রয়েছে অনেক। এখনও সংস্কৃত টোল আরএসএসের আঁতুড়ঘর। গত মাসের ১২ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত আরএসএসের বৈঠক হয়েছে এখানে। এবং সেই বৈঠকেও আরএসএসের স্থানীয় নেতারা মোদীকেই বারাণসী থেকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় প্রবীণ আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমার মুসলিম মেয়েদের নিয়ে একটি সংগঠন করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ নামের ওই সংগঠনের মহিলারা মোদীর কাছে রাখি পাঠিয়েছেন। তাঁদেরও দাবি, বারাণসী থেকে প্রার্থী হন মোদীই।
শুধু কি এঁরা? গোরক্ষপুরের বিজেপি সাংসদ যোগী আদিত্যনাথও মোদীর হয়েই ব্যাটিং করেছেন। তিনি শীর্ষ নেতাদের জানিয়েছেন, বারাণসী কেন্দ্রে মোদীকে প্রার্থী করলে শুধু যে রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে দলের ফল ভাল হবে, তা-ই নয়। লাগোয়া বিহারেও খুব ভাল ফল করতে পারে বিজেপি।
দলের নেতা-কর্মীরা যা-ই বলুন, বারাণসী কেন্দ্রটি মোদীকে সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ জোশী। গত কালই এ নিয়ে দলের সভাপতি রাজনাথ সিংহ, নরেন্দ্র মোদীর সামনে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজদের সমর্থন থাকায় বিষয়টি অন্য মাত্রা পায়। রাতেই আসরে নামেন সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। জোশীকে কড়া বার্তাও দেওয়া হয়। এর পরেই জোশী আজ বলেন, “আগামী ১৩ মার্চ সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে এ বিষয়ে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমি দলের অনুগত সৈন্য। দল যেখান থেকে লড়তে বলবে, সেখান থেকে লড়ব। এর আগেও আমি বিভিন্ন এলাকা থেকে লড়েছি।” আর এই বক্তব্যের পরে অনেকেই বলছেন, বারাণসীতে মোদী-ঝড়ের সামনে কার্যত আত্মসমর্পণ করতে হলো জোশীকে।
এই তুমুল নাটকের মধ্যেই রয়েছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। বারাণসীতে তাঁরও উপস্থিতি রয়েছে যথেষ্ট। দেওয়ালে, অটোর পিছনে কেজরীবালের ছবি-পোস্টার। রিক্সাওয়ালা থেকে দোকানদার সকলেই এখানে এক ডাকে চেনে আম আদমি পার্টির প্রধানকে। অরবিন্দ ইতিমধ্যেই জানিয়ে রেখেছেন, মোদী প্রার্থী হলে তিনিও বারাণসী থেকে লড়তে পারেন। বারাণসীর রাস্তায় সকালে আটার পুরি-আলুর তরকারি খাওয়ার জটলায় তাই ভীষণ ভাবে রয়েছে মোদী-কেজরীবালের সম্ভাব্য দ্বৈরথ নিয়ে আলোচনাও।