টোঙ্গপাল থানায় নিহতদের দেহ। —নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হতেই শক্তিপ্রদর্শনের মরিয়া চেষ্টা শুরু করল মাওবাদীরা।
গত ২৫ মে বস্তারের ঘন জঙ্গলে ঘেরা যে জিরম ঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ছত্তীসগঢ় কংগ্রেসের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে নিকেশ করে দিয়েছিল মাওবাদীরা, আজ সকালে তারই কাছাকাছি এলাকায় তারা বড়সড় আক্রমণ হানল নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে। জগদলপুর-সুকমা ২২১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে এই হামলায় নিহত হলেন ১৫ জন নিরাপত্তা কর্মী-সহ ১৬ জন। গত সপ্তাহেও দন্তেওয়াড়ার শ্যামগিরি পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে মাওবাদী হামলায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। একের পর এক এই হানাদারি রাজ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই বড় রকমের প্রশ্ন তুলেছে। ছত্তীসগঢ়ে প্রথম দফার ভোট আগামী ১০ এপ্রিল।
আজ হামলা হয় সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ। টোঙ্গপাল থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে তাকাবাদা গ্রামের কাছে। নিহতদের মধ্যে ১১ জন সিআরপি জওয়ান, ৪ জন জেলা পুলিশের কর্মী। মারা গিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর একটি গাড়ির চালকও। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠকের জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। সেই সফর কাটছাঁট করে এ দিনই তিনি রায়পুরে ফিরে আসেন। মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপাল শেখর দত্ত, দু’জনেই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। বিজেপি-শাসিত ছত্তীসগঢ়ে এই হামলার নিন্দায় টুইট করেন দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর বক্তব্য, “আমরা ছত্তীসগঢ়বাসীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলব। দেশ-বিরোধী শক্তিকে রাজ্যের উন্নয়ন যাত্রা পণ্ড করতে দেওয়া যায় না।”
রাজ্য পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মাওবাদীদের দরভা এরিয়া কমিটি এই অভিযান চালিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়েছে, দরভা ঘাঁটিতে গত বছর কংগ্রেস নেতাদের কনভয়ে যে পদ্ধতিতে হামলা হয়েছিল, এ দিনের পদ্ধতিটা কিছুটা হলেও আলাদা। এ বার পাহাড়ের বাঁকে, রাস্তা যেখানে সঙ্কীর্ণ, সেখানে গাছের ডালেও আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বেঁধে রেখেছিল মাওবাদীরা। অত্যন্ত সরু তারের সাহায্যে সেই আইইডি-তে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। দিনের আলোতেও সেই সরু তার নজরে আসা শক্ত।
ছত্তীসগঢ় পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (গোয়েন্দা বিভাগ) মুকেশ গুপ্ত জানান, সুকমার টোঙ্গপালে একটি রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। সেখানে দু’টি দলে ভাগ হয়ে তল্লাশি চালাচ্ছিল সিআরপি-র রোড ওপেনিং পার্টি (আরওপি) এবং রাজ্য পুলিশের যৌথ বাহিনী। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তাকাবাদা গ্রামের কাছে আচমকাই আইইডি বিস্ফোরণ ঘটায় মাওবাদীরা। এর পরই হতচকিত নিরাপত্তা কর্মীদের উপরে গুলিবর্ষণ শুরু হয় ঘন জঙ্গলের আড়াল থেকে। সিআরপি এবং রাজ্য পুলিশের দলটি পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু তত ক্ষণে তাঁদের ১৬ জন লুটিয়ে পড়েন। জখম হয়ে রাস্তার উপরেই পড়ে থাকেন বেশ কয়েক জন।
মুকেশ গুপ্তর দাবি, সব ধরনের সতর্কতা নিয়েই চলছিল যৌথ বাহিনী। কিন্তু ওই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে হামলা চালিয়েছে মাওবাদীরা। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা অবশ্য মনে করছেন, যৌথ বাহিনী মাওবাদী এলাকায় টহলদারির ন্যূনতম সাবধানতা (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) মেনে এগোয়নি। সুকমায় রাস্তা তৈরির কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য এই বাহিনী গত কয়েক দিন ধরে একই পথে যাতায়াত করছে, এটা মাওবাদীদের চোখ এড়ায়নি।
প্রাথমিক তদন্তে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, শ’তিনেক মাওবাদী এই হামলায় সামিল হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর দিক থেকে গুলিচালনা বন্ধ হতেই জঙ্গলের আড়াল থেকে মাওবাদীরা বেরিয়ে আসে। শুরু হয় লুঠপাট। মাওবাদীরা ৬টি একে-৪৭ রাইফেল, দু’টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৭টি ইনসাস, ৩টি গ্রেনেড লঞ্চার, ১টি হাল্কা মেশিনগান ও ২টি ওয়্যারলেস সেট নিয়ে গিয়েছে। ঘণ্টা দেড়েকের অভিযান সেরে মাওবাদীরা জঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়ার পরে উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেহগুলি তোলে।
হামলার খবর পেয়ে জগদলপুর ও রায়পুর থেকে বায়ুসেনার দু’টি হেলিকপ্টারে অতিরিক্ত বাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। নিহতদের দেহ টোঙ্গপালে পাঠানো হয় হেলিকপ্টারে। গুরুতর জখমদের আকাশপথেই পাঠানো হয় রাজধানী রায়পুরে। আহত তিন জওয়ানকে জগদলপুরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সিআরপিএফের ইনস্পেক্টর জেনারেল (অপারেশনস) জুলফিকার হাসান জানান, পলাতক জঙ্গিদের খোঁজে বড় ধরনের তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। ঘটনাস্থলের চারপাশে মাইন পেতে রেখেছে মাওবাদীরা। তাই খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনীকে। পাশের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিশেষ বাহিনীর সাহায্যও চাওয়া হয়েছে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে এই বাহিনীকে নামানো হবে।
ছত্তীসগঢ়ের রাজ্যপালকে পাঠানো এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে এমন হামলা শক্ত হাতে দমন করতেই হবে।” অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করে আজ রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের বৈঠক ডাকেন মুখ্যমন্ত্রী রমন।
ভোটের মুখে মাওবাদী সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রতি বারই। তার জন্য বাড়তি সতর্কতাও জরুরি। এ ব্যাপারে খামতি ও রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের ব্যর্থতাই কি প্রকট হচ্ছে নয়া কায়দায় মাওবাদীদের এই হামলায়?
ছত্তীসগঢ় পুলিশের ডিআইজি (গোয়েন্দা বিভাগ) দীপাংশু কাবরা রাতে আনন্দবাজারকে বলেন, “এটা কখনওই গোয়েন্দা দফতরের ব্যর্থতা নয়। ওই এলাকা অনেক দিনই শান্ত ছিল। রোড ওপেনিং পার্টিকে দেখে মাওবাদীরা আচমকা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গুলি চালিয়েছে। এটা কী ভাবে ঠেকানো যায়?” ওখানে যে মাওবাদীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, সেই খবর কি গোয়েন্দা দফতরের কাছে ছিল? পুলিশ কী ভাবে তার দায় এড়াতে পারে? ডিআইজি বলেন, “এটা গোয়েন্দা দফতরের দায় এড়ানোর প্রশ্ন নয়। সব দিক খতিয়ে দেখতেই তদন্ত শুরু হয়েছে।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের বক্তব্য, প্রতি বার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এই ধরনের হামলা চালায় মাওবাদীরা। কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এই মন্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা প্রাথমিক ভাবে রাজ্য সরকারের দায়িত্বে। কেন্দ্র পরিকাঠামোগত ভাবে সাহায্য করে মাত্র।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে জানিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে ওই এলাকায় দু’বার বড় ধরনের হামলা চালাল মাওবাদীরা। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে কেন্দ্র। এর আগে ২০১০ সালে সুকমায় মাওবাদী হামলায় নিহত হন ৭৬ জন সিআরপি জওয়ান। আবার ওই এলাকারই দরভা ঘাঁটিতে গত মে মাসে মাওবাদী হানায় নিহত হন কংগ্রেস নেতা বিদ্যাচরণ শুক্ল, মহেন্দ্র কর্মা, তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল, প্রাক্তন বিধায়ক উদয় মুদালিয়ার প্রমুখ।