ফল বেরোবে ১৬ মে। ক্ষমতায় বিজেপি আসবে ধরে নিয়েই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত দলের সভাপতি রাজনাথ সিংহ এবং নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিলেন। দিল্লিতে আরএসএসের সদর দফতর ঝান্ডেওয়ালানের কেশব কুঞ্জে কাল ওই বৈঠক হয়। মোদী সেই বৈঠকে ভাগবত ও রাজনাথকে জানিয়ে দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলের প্রবীণ নেতাদের সুষ্ঠু মর্যাদা দেবেন। তবে তিনি কিন্তু ভাগবতকে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মন্ত্রিসভা গঠনের সময় এ বার তিনি নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে চান। কারণ দেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৫ বছরের নীচে। আর এ কথা মাথায় রেখেই বিজেপি প্রার্থী বাছাই করেছিল। কাজেই বিজেপি সূত্র মনে করছে, মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রেও মোদী নবীন প্রজন্মকে বেশি করে গুরুত্ব দেবেন ।
মুরলীমনোহর জোশী কিছু দিন আগে নাগপুরে গিয়ে ভাগবতের কাছে দাবি করেছিলেন, নতুন সরকার গঠন হলে প্রবীণদেরও যেন মর্যাদা দেওয়া হয়। গত কাল সরসঙ্ঘচালকের সঙ্গে বৈঠকের পর রাজনাথ ও মোদী নিজেদের মধ্যেও এক প্রস্ত আলোচনায় বসেন। তার পর আজ সকালে রাজনাথ ফের যান ভাগবতের সঙ্গে বৈঠক করতে। গত কাল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গেও দেখা করতে গিয়েছিলেন মোদী। আজ বাজপেয়ীর দীর্ঘদিনের সঙ্গী রাজকুমারী কলের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। অরুণ জেটলি অবশ্য বলেন, “আরএসএস নেতাদের সঙ্গে মোদীর বৈঠক ছিল সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার। অনেক দিন দু’পক্ষের মধ্যে দেখা হয়নি, তাই নৈশ ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল।”
গত কিছু দিন বিজেপির শীর্ষ নেতারাও অনেকেই অনেক দিকে প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। আজ শ্রীমতি কলের স্মরণ-সন্ধ্যায় তাঁদের দেখা হয়। নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনায় মন্ত্রিসভার গঠন নিয়েও কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। যদিও কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, “মোদী তো নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে ভাবছেন। ১৬ মে ফল বার হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। আর ১৭ মে থেকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবেন।” ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যা-ই হোক বিজেপি সূত্র বলছে, যদি সত্যি সত্যিই সরকার গড়তে হয় তখন তো শিরে সংক্রান্তির দশা হবে। সেই পরিস্থিতি এড়াতে হোমওয়ার্ক করে রাখাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়!
মোদীকে নিয়ে আরএসএসের কিন্তু ভয়ও রয়েছে। কারণ আরএসএস যে ভাবে রাজনাথ ও নিতিন গডকড়ীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে ভাবে মোদীকে নিয়ন্ত্রণ করাটা তাদের পক্ষে অসম্ভব। বিশেষ করে সঙ্ঘ নেতারা এটাও বুঝতে পারছেন, মোদী যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেন, তবে মন্ত্রিসভা গঠন থেকে নীতি-নির্ধারণ কোনও ব্যাপারেই আরএসএসের প্রতিনিয়ত নাক গলানো বরদাস্ত করবেন না। মোদী চাইছেন, সঙ্ঘ বিজেপিকে মতাদর্শগত ভাবে পথ দেখাক। কিন্তু দৈনন্দিন কার্যকলাপে যেন মাথা না গলায়। এনডিএ সরকারের জমানায় বাজপেয়ীও এমনটাই চেয়েছিলেন।
বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে, মুরলীমনোহর আরএসএসের সাহায্য নিয়ে স্পিকার পদটি পেতে আগ্রহী। কিন্তু ওই পদে সুষমা স্বরাজকে বসিয়ে তাঁকে ‘বিগ ফোর’-এর বাইরে রাখারও একটি প্রস্তাব রয়েছে। অনেকে লালকৃষ্ণ আডবাণীকেও স্পিকার পদে আসীন করে তাঁকে মোদী-বিরোধী বিক্ষুব্ধ নেতাদের থেকে আলাদা রাখার কথা ভাবছেন। তবে এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে লোকসভায় প্রবীণতম সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি আডবাণীর। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রোটেম স্পিকার হবেন। এবং স্পিকার নির্বাচন প্রক্রিয়ার পৌরোহিত্য করবেন।
রাজনাথ এর আগে দু’বার বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, দলের সভাপতি পদেই থাকতে আগ্রহী। কিন্তু মোদী আরএসএস নেতৃত্বকে জানিয়েছেন যে তিনি রাজনাথকে মন্ত্রিসভায় আনতে চান। এমনকী, রাজনাথকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দিতেও মোদীর আপত্তি নেই। মোদী শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি হবেন প্রথম আরএসএস প্রচারক যিনি এই পদে আসীন হচ্ছেন। কারণ বাজপেয়ী সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারক ছিলেন না। রাজনাথ হলেন আরএসএসের নিজস্ব প্রতিনিধি। তাই মন্ত্রিসভায় রাজনাথ থাকুক, সেটা ভাগবতেরও ইচ্ছা। সে ক্ষেত্রে সঙ্ঘ ফের গডকড়ীকে বিজেপির সভাপতি করতে আগ্রহী। কিন্তু বিজেপির অনেক শীর্ষ নেতারই এতে আপত্তি রয়েছে। প্রবীণদের মধ্যে যশবন্ত সিন্হা কিংবা মুরলীমনোহরের মতো কাউকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করার কথাও ভাবনাচিন্তায় রয়েছে।
জেটলি গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মোদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি যে ভাবে মোদীকে প্রতিটি বিষয়ে সমর্থন করেছেন তাতে অমৃতসরের ফল যা-ই হোক, রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা জেটলি যে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে চলেছেন, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। জেটলিকে অর্থমন্ত্রী করারও প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু নরসিংহ রাওয়ের জমানায় যে ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় না হয়ে মনমোহন সিংহের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আকস্মিক আবির্ভাব হয়েছিল, সে ভাবে কোনও টেকনোক্র্যাটের নাম মোদীর ঝুলিতে আছে কি না সেটাও প্রশ্ন। কোনও কোনও মহল থেকে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্তা কে ভি কামাথের নামও চাউর করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে জেটলিকে স্বরাষ্ট্র বা বিদেশ মন্ত্রক দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। আর সুষমা যদি বিদেশমন্ত্রী হন, তা হলে জেটলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারেন। তবে এ বারের মন্ত্রিসভায় রবিশঙ্কর প্রসাদ, স্মৃতি ইরানি, শাহনওয়াজ হুসেন, রাজীবপ্রতাপ রুডি, পীযূষ গয়াল, অনুরাগ ঠাকুরদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যেতে পারে।
ভোটের ফল অন্য কিছু হতেই পারে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মোদী এবং রাজনাথ নিঃশব্দে সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার গঠনের কাজটা শুরু করে দিয়েছেন।