ভোটের আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে যোজনা কমিশনের ভূমিকা নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এ বার যোজনা কমিশনের প্রাসঙ্গিকতা ধাপে ধাপে লঘু করার প্রক্রিয়া শুরু করলেন নরেন্দ্র মোদী। যার স্পষ্ট আভাস মিলেছে দু’টি ঘটনা থেকে। এক, কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে এখনও কাউকে নিয়োগ না করা। দুই, বাজেট তৈরির কাজে যোজনা কমিশনকে কার্যত এড়িয়ে যাওয়া।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই মোদী দিল্লিতে এসে বলে গিয়েছিলেন, রাজ্যগুলির হাতে আরও অধিকার থাকা উচিত। কমিশন শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অনেকটাই ছেড়ে দেওয়া উচিত রাজ্যগুলির হাতে। কমিশনই সব কিছু বেঁধে দেবে, এমনটা হতে পারে না।
এখন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে সেই প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী।
সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে কমিশনের ভূমিকা নতুন করে বেঁধে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। ডানা ছাঁটার জন্য দরকারে যোজনা কমিশন নামটাই বদলে দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষ হলে সরকার এ নিয়ে এগোতে পারে বলেই সরকারি মহলের ইঙ্গিত।
তবে প্রশ্ন হল, প্রশাসনিক সংস্কারের ইচ্ছে থাকলেও কতটা করতে পারবেন মোদী? মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ও যে সংস্কারের প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছ থেকে, সেটি কিন্তু তিনি করে দেখাতে পারেননি। যোজনা কমিশনের ক্ষেত্রে অবশ্য মোদীর ভূমিকায় একটা দিশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তিনি এখন যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান। স্বাধীন দায়িত্ব দিয়ে পরিকল্পনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করেছেন রাও ইন্দ্রজিৎ সিংহকে। কিন্তু এখনও কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে কাউকে নিয়োগ করেননি। মনমোহন সিংহ জমানার ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে শূন্যই রয়েছে পদটি। কাউকে ওই পদে বসানো হবে কি না, সে ব্যাপারেও কোনও ইঙ্গিত দেননি প্রধানমন্ত্রী।
কমিশনের এক কর্তার অবশ্য বক্তব্য, “এমন নয় যে অতীতে সব সময়ই ডেপুটি চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। গুলজারিলাল নন্দা, নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি থেকে মাধব সিংহ সোলাঙ্কির মতো অনেকে মন্ত্রী হিসেবেই কমিশনের দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে তা হয়নি। প্রণব মুখোপাধ্যায়, যশোবন্ত সিংহ, কে সি পন্থ, মন্টেকরা ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেই কমিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রীরা চেয়ারম্যান হিসেবে।
নতুন চেয়ারম্যান এ বার চাইছেন কমিশনের ভূমিকাতেই একটা বদল আনতে। যে কারণে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আগামী মাসে বাজেট পেশ করার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সে কাজে কমিশনকে কোনও ভাবেই সামিল করা হচ্ছে না।
অথচ বাজেট তৈরির সময় যোজনা কমিশনকে একটি বড় ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে এত দিন। বিশেষ করে এ সময় রাজ্য ও মন্ত্রকগুলির মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করে থাকে যোজনা কমিশন। তারাই অর্থ মন্ত্রককে জানায় পরিকল্পনা খাতের বাজেট কত হবে। অন্তত ত্রিশ শতাংশ বাজেট তৈরির কাজে সক্রিয় ভূমিকা থাকে কমিশনের। এ বারে কিন্তু কমিশনকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে অর্থ মন্ত্রকই সরাসরি রাজ্য ও মন্ত্রকগুলির কাছে বরাদ্দের প্রস্তাব চেয়ে পাঠিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রকের এক সূত্রের মতে, জওহরলাল নেহরু যখন যোজনা কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই সময় নিশ্চয়ই এমন ভাবনা ছিল না যে, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া পরিকল্পনা খাতে একটি পয়সাও খরচ করা যাবে না। রাজ্য ও মন্ত্রকগুলির উপর কমিশনের এই চোখ-রাঙানি নিয়ে অতীতেও অনেক সমস্যা হয়েছে। বিশেষ করে নিজেদের প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা না থাকায় রাজ্যগুলিও বারবার এই ব্যবস্থার সমালোচনা করে এসেছে।
মনমোহন তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্টেককে যোজনা কমিশনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার পর থেকেই ইউপিএ সরকারের নীতি রূপায়ণে যাতে যোজনা কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, সে বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন মন্টেক। পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিভিন্ন মন্ত্রককে রীতিমতো নির্দেশ পাঠাত মন্টেকের যোজনা কমিশন। বিভিন্ন মন্ত্রকের কাজের মূল্যায়ন করে প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্টও পাঠাত যোজনা কমিশনই। আধার প্রকল্পের মতো বিভিন্ন নীতিগত বিষয়ে মন্টেকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রক বা অন্যান্য মন্ত্রকের বিরোধও বেঁধেছে একাধিক বার। দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা পাল্টে দিয়ে তো তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন মন্টেকরা।
ফলে কমিশনের ভূমিকা বদলের দাবি শুধু মোদীর মুখে নয়, অন্যান্য মহল থেকেও উঠে এসেছে বারবার। বর্তমান লোকসভার সদস্য না হলেও অতীতে বেশ কয়েক দফায় কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রক সামলেছেন পি চিদম্বরম। ব্যক্তিগত ভাবে তিনিও মনে করেন, যোজনা কমিশনের ক্ষমতা ছেঁটে দেওয়া প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “বহরে পেল্লায় শুধু নয়, যোজনা কমিশনের কাজকর্মও সুসংহত নয়। আমি মনে করি, যোজনা কমিশনের এক্তিয়ার অনেক সীমিত হওয়া উচিত। শুধু সম্ভাব্য যোজনার রূপরেখা তৈরিই তাদের দায়িত্ব হতে পারে।”
প্রায় একই মত যোজনা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য সচিব সুধা পিল্লাইয়েরও। সুধাও বলেন, “কমিশনের হাতে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠার ক্ষমতা থাকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।”
এই পরিস্থিতিতে কমিশনের থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও বেশি ক্ষমতাশালী করার প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনা চলছে সরকারের অন্দরে। সরকারি কাজকর্মের নিত্যদিনের খুঁটিনাটির বদলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির কাজে কমিশনকে ব্যবহার করার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এ বার সেই ভাবনা কতটা বাস্তবায়িত করতে পারেন, সেটা দেখা যাবে বাজেট অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে।