অনাবাসী সম্মেলন

লগ্নির ঝুলি নিয়ে ওঁরা হাজির, তবে দূরে থাকে শুধু বাংলাই

সময় গড়িয়ে গিয়েছে তিন বছর। ছবিটা সেই একই আছে। বাংলার শিল্প-উদ্যোগে স্থবিরতার ছবি। তিন বছর আগে রাজস্থানের জয়পুরে বসেছিল ‘প্রবাসী ভারতীয় দিবস’-এর সম্মেলন। নিহিত লক্ষ্য, অনাবাসী-বিনিয়োগ আকর্ষণ। উপস্থিত তাবড় অনাবাসী শিল্পোদ্যোগীর মধ্যে ছিলেন সুইস বহুজাতিক বায়োটেক সংস্থার মঙ্গত শর্মা, দক্ষিণ আফ্রিকার একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্ণধার রবি মালিক এবং হলিউডের অ্যানিমেশন ইঞ্জিনিয়ার পুষ্পেন্দ্র মল্লিক।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২২
Share:

সময় গড়িয়ে গিয়েছে তিন বছর। ছবিটা সেই একই আছে। বাংলার শিল্প-উদ্যোগে স্থবিরতার ছবি।

Advertisement

তিন বছর আগে রাজস্থানের জয়পুরে বসেছিল ‘প্রবাসী ভারতীয় দিবস’-এর সম্মেলন। নিহিত লক্ষ্য, অনাবাসী-বিনিয়োগ আকর্ষণ। উপস্থিত তাবড় অনাবাসী শিল্পোদ্যোগীর মধ্যে ছিলেন সুইস বহুজাতিক বায়োটেক সংস্থার মঙ্গত শর্মা, দক্ষিণ আফ্রিকার একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্ণধার রবি মালিক এবং হলিউডের অ্যানিমেশন ইঞ্জিনিয়ার পুষ্পেন্দ্র মল্লিক। পূর্ব পুরুষের সূত্রে প্রথম দু’জনের শিকড় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আর তৃতীয় জনের জন্ম এ রাজ্যে। নাড়ির টানে তিন জনই চেয়েছিলেন, বাংলার জন্য কিছু করতে। আশা করেছিলেন, সম্মেলনে নিশ্চয়ই মমতা সরকারের কোনও বড় কর্তার দেখা মিলবে, যাঁর সঙ্গে কথা বলে ছকে ফেলা যাবে বঙ্গে বিনিয়োগের প্রাথমিক রূপরেখা।

কোথায় কী! সরকারি কর্তা দূর, পশ্চিমবঙ্গের একটা স্টলও ওঁদের চোখে পড়েনি। তিন দিনের সম্মেলন শেষে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মঙ্গত-পুষ্পেন্দুরা।

Advertisement

লগ্নি আকর্ষণে পশ্চিমবঙ্গের সেই উদাসীনতাই আবার প্রকট হয়েছে গুজরাতে সদ্য অনুষ্ঠিত প্রবাসী সম্মেলনে। গত ৭-৯ জানুয়ারি গাঁধীনগরের ওই অনুষ্ঠানে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি ছিলেন মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব, কেরল, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীরা। সরকারি প্রতিনিধিদল সমেত। ছিলেন আরও কয়েকটি রাজ্যের শীর্ষ কর্তারা। প্রবাসীরা লগ্নি করলে কী কী সুবিধা পাবেন, পরিকাঠামো কেমন হবে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের সামনে তা যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে ওঁরা চেষ্টার কসুর করেননি। সেই মঞ্চে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১২-য় জয়পুরের সম্মেলন থেকে রাজস্থান সরকারের প্রাপ্তি হয়েছিল ১ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা অনাবাসী লগ্নির প্রাথমিক চুক্তি। কেরলের ঝুলিতে ঢোকে ৬২ হাজার কোটির প্রস্তাব। তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্র, গুজরাতও বিপুল লগ্নির আশ্বাস নিয়ে ফিরেছিল। আর এ বার গাঁধীনগরের সম্মেলনের প্রথম দু’দিনে এগারোটি রাজ্যের সঙ্গে অনাবাসীরা মোট ৯ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ‘মউ’ করেছেন বলে ফিকি-সূত্রের খবর।

স্বাভাবিক ভাবেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই। যা নিয়ে উদ্যোক্তাদের আক্ষেপেরও অন্ত নেই। প্রবাসী সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক পুরুষোত্তম অগ্রবালের কথায়, “গাঁধীনগরে অন্তত একটা স্টল দেওয়ার জন্য কলকাতায় অনেক বার চিঠি দিয়েছি। ফোনে অনুরোধ করেছি। বাংলার প্রতিনিধিরা যাতে সভার শুরুর দিকে বলতে পারেন, সে ব্যবস্থাও হয়েছিল। তবু কেউ এলেন না!”

পুরুষোত্তমবাবু আদতে জলপাইগুড়ির ছেলে। তাই পশ্চিমবঙ্গকে হাজির করানোয় তাঁর বাড়তি উৎসাহ ছিল। নবান্নের অনাগ্রহ ওঁর সব উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি পাঠাল না কেন?

রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “এখানে একই রকম একটি অনুষ্ঠান থাকায় যাওয়া যায়নি। ২০১২-য় ওই সময়টায় হল বেঙ্গল লিডস। এ বার, বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট।” প্রতিনিধিদল না হোক, অন্তত এক জনকেও পাঠানো গেল না কেন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য সরকারি তরফে মেলেনি।

রাজ্যের শিল্প-বাণিজ্য মহলের বড় অংশ অবশ্য পুরো ব্যাপারটাকে ‘যথাস্থানে উদ্যমের অভাব’ হিসেবেই দেখছে। বস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের জমি-নীতি ও জমির উর্ধ্বসীমা আইনের বাধা তো আছেই, রাজ্য জুড়ে সিন্ডিকেটের রমরমা, শিল্প-আঙিনায় তোলাবাজি, আইন-শৃঙ্খলা, এবং সার্বিক ভাবে সরকারের শিল্প-প্রতিকূল ভাবমূর্তির সুবাদে গত সাড়ে তিন বছরে বিশেষ বড় বিনিয়োগ আসেনি। ইতিমধ্যে সরকার তিন বার শিল্প সম্মেলন করেছে। মুম্বই, সিঙ্গাপুরে রোড শো হয়েছে। তবু শিল্পের মন পাওয়া যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী শেষমেশ বাম আমলে প্রতিশ্রুত ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার বিনিয়োগকেই নিজেদের বলে দাবি করেছেন, যা ঘিরে শিল্প ও প্রশাসনিক মহল আলোড়িত।

এমতাবস্থায় বণিকসভাগুলোর একাংশ বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি দেখে যেমন এখানে কেউ টাকা ঢালতে সাহস করছে না, তেমন লগ্নি আকর্ষণে রাজ্য আদৌ আন্তরিক কি না, হলে কতটা আন্তরিক, তা নিয়েও এখন ঘোর সংশয়। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিবিধ প্রতিশ্রুতির ফানুস ফুটো হওয়াতেই যার উৎপত্তি। কী রকম?

এ প্রসঙ্গে পিত্রোদা-পর্বের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক শিল্প-কর্তা। ক্ষমতায় এসেই অনাবাসী বিনিয়োগ টানার জন্য দিল্লি থেকে শ্যাম পিত্রোদাকে উড়িয়ে এনেছিলেন মমতা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অনাবাসী বাঙালির ঘরে ঘরে ‘পরিবর্তনের’ রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনার বার্তা পৌঁছে দেবে তাঁর সরকার। উদ্যোগের গালভরা নামও দেওয়া হয় রিসারজেন্ট বেঙ্গল। অর্থাৎ, পুনরুজ্জীবিত বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের পুনরুজ্জীবন কোন পথে সম্ভব, পুনরুজ্জীবিত রাজ্যের ছবি বিশ্বের দরবারে কী ভাবে তুলে ধরা যাবে, পিত্রোদার কাছে সেই পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল।

পিত্রোদাও চেয়েছিলেন মমতার পরিবর্তনের ডাককে হাতিয়ার করে এগোতে। নবান্নের খবর: মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের অফিসারদের সঙ্গে তিনি ভিডিও কনফারেন্স করেন। দুই আইএএস অফিসারকে নিয়ে গড়া হয় ওয়ার্কিং কমিটি। স্থির হয়, কলকাতায় অফিস বানিয়ে ‘টিম পিত্রোদা’ কাজ করবে। পিত্রোদার ইচ্ছে ছিল, বাঙালির প্রাতরাশের টেবিলেই রাজ্যের পুনরুজ্জীবন-বার্তা পৌঁছে দেওয়া হোক। সেই লক্ষ্যে পরিকল্পনা হয় ঝকঝকে মলাটের নজরকাড়া একটি বইয়ের কফি টেব্ল বুক অন বেঙ্গল। তাতে রাজ্যের প্রাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাস উঠে আসবে লেখায়, ছবিতে। পিত্রোদা চেয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিক ও বিদেশে ছড়িয়ে থাকা এক হাজার বাছাই বাঙালির হাতে বইটি তুলে দিতে। একটা ওয়েবসাইট তৈরিরও কথা হয়, যার মাধ্যমে বিশ্ব দেখতে পাবে, কী ঘটে চলেছে এ রাজ্যে।

এত চিন্তা-ভাবনার কিছুই অবশ্য দিনের আলো দেখেনি। “আর উচ্চবাচ্য শোনা গেল না! ফাইলে ধুলো জমে গিয়েছে। সরকারের চাড় নেই দেখে পিত্রোদাও হাল ছেড়ে চলে গিয়েছেন।” বলেন নবান্নের এক কর্তা।

অনাবাসী-লগ্নি টানার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারের তরফে উদ্যমের অভাব গোড়া থেকেই প্রকট। কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘প্রবাসী ভারতীয় দিবস’ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ২০০৩-এ। ‘সরকারি’ উদ্দেশ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের মাতৃভূমির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে বাঁধা। তবে বিভিন্ন রাজ্য মূলত অনাবাসী-লগ্নি টানতেই সম্মেলনের মঞ্চকে ব্যবহার করে থাকে। কেন্দ্রের এক মুখপাত্র জানান, ফি বছর এক-এক রাজ্যকে প্রবাসী সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

২০১২-য় যেমন পশ্চিমবঙ্গ প্রথম প্রস্তাব পেয়েছিল। তারা রাজি না-হওয়ায় রাজস্থান এগিয়ে আসে। জোগাড় করে নেয় বিপুল লগ্নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন