‘বোস’-এর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রদর্শনীতে সিইও বব মারেস্কা। পিছনের ছবিতে প্রতিষ্ঠাতা অমরগোপাল বোস।—নিজস্ব চিত্র।
আজকের প্রযুক্তি বিশ্বে মোবাইল-শব্দই ব্রহ্ম! গান শোনার জন্য ড্রয়িংরুম আলো করা ছ’স্পিকার আর অ্যামপ্লিফায়ারের যুগ এখনও শেষ হয়নি বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম চাইছে তার হাত-যন্ত্রটিতে পছন্দের গান দ্রুত ডাউনলোড করে নিভৃতে শুনতে। কিংবা ব্লু-টুথের মাধ্যমে তা বন্ধুদের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করে নিতে।
এই সার সত্য উপলব্ধি করেই এ বার মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে প্রযুক্তিগত গাঁটছড়া বাঁধার কথা ভাবছে ‘বোস কর্পোরেশন।’ ধ্বনির জগতে কার্যত অদ্বিতীয় বঙ্গসন্তান অমরগোপাল বোসের হাতে গড়া সংস্থায় এই লক্ষ্যে গবেষণাও শুরু হয়ে গিয়েছে। নিউ ইয়র্কে সংস্থার সর্বোচ্চ সূত্রে এই খবর পাওয়া গিয়েছে।
প্রয়াত অমরগোপাল শুধু যে ‘বোস’-এর প্রাণপুরুষ ছিলেন তা-ই নন, ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ (এমআইটি)-র এই প্রাক্তনী নিজের সংস্থা সামলানোর পাশাপাশি এমআইটি-তে পড়িয়েওছেন চার দশক। সেই সময়েরই এক ছাত্র কেন জ্যাকবস। বর্তমানে ‘বোস’-এর অন্যতম ডিরেক্টর তিনি। ১৯৮৪ সালে পাশ করার পর থেকে গত বছরের জুলাইয়ে অমরগোপালের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন এই কেন। তিনি বললেন, “আমাদের বড় স্পিকারের ব্যবসা এখনও যথেষ্ট ভাল চলছে। প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখন আমরা ছোট স্পিকার, ফ্রি স্টাইল ইয়ারবাডও বাজারে এনেছি। মোবাইল প্রযুক্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে।”
ঠিক কী ভাবে সম্ভব হতে পারে বিষয়টি, তা অবশ্য এখনও খুব একটা ভেঙে বলেননি কেউ। তবে কারও কারও মতে, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে হয়তো কোনও বিশেষ সংস্থার মোবাইলের সাউন্ড সিস্টেমটাই তৈরি করবে বোস। ফলে ফোনে কথা বলা তো বটেই, ইয়ারবাড ছাড়া গান শোনাটাও হবে রীতিমতো মখমলে অনুভূতি। অর্থাৎ ‘বোস’-এর ধ্বনি ম্যাজিকের জন্য গ্রাহককে আর স্পিকার বা অ্যামপ্লিফায়ারের ঝামেলা পোহাতে হবে না। এমনকী চাইলে কানে ইয়ারবাড (তাদের অন্যান্য পণ্যের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সস্তায় যা ইতিমধ্যেই বাজারে এনেছে বোস) গোঁজারও প্রয়োজন নেই। চৌরাস্তার মোড়ে, শপিং মলে, বিমানবন্দরে কিংবা গভীর রাতের শয়নকক্ষে মোবাইলে বেজে উঠবে অর্ধশতাব্দী ধরে মানুষকে বুঁদ করে রাখা সেই ধ্বনি। যে গান শোনা যাবে, তাতে থাকবে বোস-এর বিখ্যাত ‘নয়েজ-ক্যানসেলিং’ প্রযুক্তির ছোঁয়া।
অমরগোপাল গবেষণা করে দেখেছিলেন, প্রেক্ষাগৃহের গানবাজনার ৮০ শতাংশ সরাসরি শ্রোতার কানে আসে না। আসে দেওয়ালে-ছাদে ধাক্কা খেয়ে। পদার্থবিদ্যার সেই সূত্র কাজে লাগিয়েই তৈরি করেছিলেন নিজের প্রথম সাউন্ড সিস্টেমের নকশা। দেওয়ালের দিকে তাক করা অনেকগুলো ছোট ছোট স্পিকার যাতে সরাসরি আসা স্পিকারের শব্দ ও দেওয়ালে প্রতিফলিত শব্দের মিশেলে বৈঠকখানায় বসেই পাওয়া যায় প্রেক্ষাগৃহের মজা। ১৯৬৮ সালে তৈরি ‘বোস ৯০১ ডিরেক্ট/রিফ্লেক্টিং স্পিকার পরবর্তী টানা ২৫ বছর বেস্ট সেলার ছিল। তারই হাত ধরে পরপর বাজারে আসে বোস-এর ‘ওয়েভ রেডিও’ ও বিখ্যাত ‘নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন’, যা সেনাবাহিনী থেকে নাসা পর্যন্ত ব্যবহার করতে শুরু করে। এখন মোবাইলের সাউন্ড সিস্টেমেও শেষ পর্যন্ত বোস-এর ছোঁয়া পড়লে তার উৎকর্ষ কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে, সেটাই ভাবছেন যন্ত্রপাগলরা।
নিউ ইয়র্কে বোস কর্পোরেশনের পঞ্চাশ বছর উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনীতেও সেই মূল সুরটি ধরা পড়ল। সংস্থার বর্তমান সিইও বব মারেস্কা বলছেন, “অমর বোস সর্বদাই বলতেন- লাভ নয়, আমার লক্ষ্য ধ্বনিক্ষেত্রে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের সংস্থা শুধুমাত্র ডলার কামানোর জন্য বড় হয়নি। বরং আরও বেশি মানুষকে সেরা প্রযুক্তিটুকু পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে বেড়ে উঠেছে।” সংস্থার বক্তব্য, অমরগোপাল নিজেও মোবাইল প্রযুক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে গিয়েছিলেন। তিরিশ বছর আগে তিনিই ভেবেছিলেন, হাইওয়ের চলন্ত গাড়িতে এনে দিতে হবে কনসার্ট হলে গান শোনার অনুভূতি। কার স্টিরিও নিয়ে চুক্তি করেছিলেন জেনারেল মোটরস-এর সঙ্গে। আজও মার্সিডিজ এবং পোর্শের গাড়িতে বোস-এর সাউন্ড সিস্টেমই ব্যবহার করা হয়।
নিউ ইয়র্কের সোহো এলাকার কাছেই যে বিশাল হলঘর জুড়ে বোস কর্পোরেশনের পঞ্চাশ বছরের পথ চলার উৎসব, তা আসলে সংস্থার কর্মীদের পক্ষ থেকে প্রাণপুরুষের প্রতি এক সুরেলা শ্রদ্ধার্ঘ্যই বটে। সেখানে ১৯৬৮ সালে তৈরি বোস-এর আদি স্পিকারের দেখা যেমন মিলল, তেমনই দেখা গেল হালফিলের ‘সাউন্ডলিঙ্ক’ স্পিকার। তাতে বাজছে রক, ব্লুজ, ব্যালাড। চর্তুদিকে ছয়লাপ এমআইটি-র প্রাক্তন ছাত্ররা। ডিরেক্টর কেন জ্যাকবসের মতো এঁরাও বোস-এর বর্তমান কর্তা। সংস্থার শেয়ারের বেশির ভাগটাই এমআইটি-কে দান করে গিয়েছিলেন অমরগোপাল। শর্ত ছিল দু’টো। শেয়ার বিক্রি করা যাবে না এবং সংস্থার পরিচালন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
প্রদর্শনী ভবনের একটি তলায় দেখানো হচ্ছে রোমের সিস্টিন চ্যাপেল, মক্কার প্রধান মসজিদ, লস অ্যাঞ্জেলস-এর স্টেপলস সেন্টারে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেমের জনক অমরগোপালের জীবন ও গবেষণা নিয়ে তথ্যচিত্র। ক্যামেরা ফিরছে অতীতেও। তাঁর বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীগোপাল বোস ১৯২০তে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই পালিয়ে আসেন আমেরিকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিশোর অমরগোপাল হাতখরচ জোটাতেন একটি রেডিওর দোকানে কাজ করে। বাবার ব্যবসা উঠে গেলে নিজেই কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেছিলেন দোকান। গত পঞ্চাশ বছরে ধাপে ধাপে বিশ্বের প্রথম চারশো জন কোটিপতির তালিকায় উঠে এসে আজ ইতিহাস গড়েছেন সে দিনের সেই রেডিও সারাইওয়ালা।