আসছে সে আসছে।
কে আসছে বলুন তো। কার আসার কথা?
ওই দেখুন, সে আসছে আর আপনি কি না বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন।
দেখুন মশাই অমন হেঁয়ালি ছেড়ে একটু ঝেড়ে কাশুন দিকি।
কেন, ১৪২১ আসছে।
১৪২১?? তা হ্যাঁ, সাত দুগুণে চৌদ্দো আর তিন সাত্তে একুশ। এর আবার আসাআসির কী আছে। এ তো সোজা হিসেব। তা মশাই এই ভোটের বাজারে কোনও পাওনা গণ্ডা মিলবে না কি এমন নামতা হেঁকে। নাকি এই ইংরেজি ২০১৪ সালটাকে একটু উল্টে পাল্টে তার সঙ্গে এক যোগ করে দিলেন।
বাহ বাহ বাহ, বেড়ে বলেছেন তো মশাই। ১৪২১ কে নিয়ে কত রঙ্গই না করলেন।
তা কী করব, ওই নম্বরগুলোকে কী গায়ে উল্কি কেটে বসিয়ে রাখব?
আহা হা, উল্কি কেন উল্কি কেন, ওতে বড় যন্তন্না। তার থেকে মস্তিষ্কে পাচার করে দিন। কম্পিউটারের ডেটার মতো মগজে স্টোর হয়ে থাকবে।
না মশাই, আপনার সঙ্গে বকবক করার মতো বাজে সময় আমার হাতে নেই। এই আমি চললুম, আমার কাজ আছে।
আরে কাজ তো রোজই থাকবে কিন্তু বচ্ছরকারের দিনটা তো রোজ আসবে না। পয়লা বোশেখ বছরে একটাই আসে। এসে গেল যে সেই দিনটা ১৪২১ সালকে নিয়ে। নতুন বছর। বাংলা নববর্ষ।
ও তাই বলুন, সেই জন্যই অমন ১৪২১, ১৪২১ করে চিল্লামিল্লি জুড়েছিলেন? তা আগে বলবেন তো।
আগে বলিনি, একটু পরখ করে দেখছিলুম আপনার মনে আছে কি না বাংলা নববর্ষের কথাখানা।
কী করে মনে থাকবে মশাই। এই তো দেখছেন দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছি। অফিস আর বাড়ি আবার বাড়ি আর অফিস। এই পরবাসে অফিসে গুটিকয়েক বাঙালি আছে কী নেই তাদের সঙ্গে কটা বাংলা কথা হল কী হল না তা বেশির ভাগ সময়টা হ্যাট ম্যাট ক্যাট ইংরিজি বুলি কিংবা দেশের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি বলে চালাতে হয়। আর বাড়িতে সে তো আরও এক কাঠি বাড়া। ছেলেপুলেরা হিন্দি ইংরিজি বাংলা মিশিয়ে কী যে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে! আর গিন্নি? আমি তো মনে মনে অবাক হয়ে ভাবি আমার এই পাতি বাঙালি বউটার এমন দশা হল কী করে। উনি এখন এমন টানে বাংলা বলেন যে মনে হয় যেন কোনও অবাঙালি বাংলা বলছে। এই সব দেখেশুনে মাঝে মাঝে কেন ভ্রম হয় বুঝেছেন কোনওদিন বাঙালি ছিলাম তো? তা এর পরেও আপনি আমার দোষ ধরছেন বাংলা নববর্ষ মনে রাখতে পারিনি বলে?
তা ঠিক তা ঠিক, আপনাকে দোষ দিয়ে আর কী হবে? আপনিও তো মশাই ইঁদুরকলের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। এখান থেকে বেরোনোর আর উপায় নেই।
যা বলেছেন, হেঁ হেঁ, ইঁদুরকলের ফাঁদ। আমরা সব এক একটা ইঁদুরই তো বটে।
ওই যে ইংরিজিতে একটা কথা আছে না? ‘র্যাট রেস’ ইঁদুর দৌড়। আমরা সব ছুটছি কে কার আগে পৌঁছবে কিন্তু কোথায় পৌঁছব বা আদৌ কোথাও পৌছব কি না না কি এই ফাঁদের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে মরব, তা কেউ জানি না। আমরা ছুটছি আর আমাদের জীবনের এক একটা নববর্ষ বাংলা নতুন বছর ঝরে যাচ্ছে শুকনো পাতার মতো।
অথচ এই নববর্ষগুলোই কত সজীব ছিল কত সবুজ ছিল এককালে।
মনে পড়ে যাচ্ছেছবির মতো সব মনে পড়ে যাচ্ছে। কয়েকটা বছর যেন পিছিয়ে যাচ্ছে মনটা। সে-ই দিনগুলোয় নববর্ষের আগের রাতটা ভাল করে ঘুম হত না। উত্তেজনায় বুঝেছেন উত্তেজনায়। হিসেব করে রাখতাম কটা দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন হয়েছে। লুচি, আলুর দম, বোঁদে, ঠান্ডা শরবত। বাড়ি ফিরে আর খাওয়া নেই। রাতে আবার পাড়ার জলসা। পাড়ার যে তন্বীকে সব থেকে ভাল লাগত, তার কোকিলকণ্ঠের গান শুনব বলে কী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। এখন সে সব স্বপ্ন। সেই কোকিলকণ্ঠী রূপসীও এক দিন বাংলা নববর্ষের মতোই কোথায় স্মৃতির আড়ালে চলে গেল। তার পর জীবনের অনেকটা পথ বেয়ে আজ এইখানে আরব সাগরের তীরের বালুকাবেলায় তার নামটা লিখে যেতে ইচ্ছে করে। জানি সাগরের ঢেউ এসে তাকে মুছে দেবে, তবুও...।
দেখুন দিকি, বাংলা নববর্ষ আপনাকে কোথায় নিয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছে না যেন এক বিস্মৃত সঙ্গীত ভেসে আসছে বহুদূর থেকে। সেই গান যেন আপনার মনতটিনীর দুকূল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে। কোথা থেকে যেন এক অদ্ভুত ভাললাগা এসে আপনার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে।
একদম ঠিক বলেছেন। মনে পড়ে যাচ্ছে রবিঠাকুরের সেই গান, ‘কী বেদনা মোর জান সে কী তুমি জান/ওগো মিতা, মোর অনেক দূরের মিতা।’ যদিও এটি বর্ষার গান তবু এ সময় এই গানটিই মনে এল।
তা হোক, বর্ষার গানই এখন আপনার মনের অবস্থায় মানানসই। আপনার মনটা যে রকম স্মৃতিমেঘমেদুর হয়ে উঠেছে তাতে বর্ষণ হল বলে।
না না ঠাট্টা নয়, মনটা সত্যি বড় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে নিজের মাকে যেন নির্বাসন দিয়েছি। যে মায়ের কোলে কাঁধে ছেলেবেলার দিনগুলো কাটিয়েছি মায়ের কাছে কত আবদার, কত দুষ্টুমি করেছি আদায় করেছি মায়ের ভালবাসার প্রতিটি কণা। তিল তিল করে আমাদের মা নিজের রক্ত দিয়ে আমাদের বড় করে তুলেছেন। আর বড় হয়ে আমরা তাঁকে ভুলে গেছি। আমরা সেই বাংলা মায়ের কোল ছেড়ে কোথায় কত দূরে পড়ে রয়েছি। বাংলা ভাষা আজ যেন আমাদের কাছে ব্রাত্য। বাংলা নববর্ষের সাল তারিখ মনে থাকে না। বাংলা মায়ের জন্য কিছুই তো করে যেতে পারলাম না, তা তাঁর এই সম্মানটুকু রাখার দায়িত্বও কী আমাদের নেই? আমরা কেমন সন্তান তাঁর?
...সুধীজন এ বড় মোক্ষম প্রশ্ন। মনে করুন না কেন এতক্ষণ ক্যামেরা চলছিল। ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে পরিচালক হঠাত্ বলে উঠলেন ‘কাট’। কারণ পরিচালকের কাজ শেষ। এর পরের ভাবনা ভাবার দায়িত্ব সুধীজনের। আপনারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন, ধুর, এ আবার কী, গল্পের শেষ হল না, মাঝাখানে দাঁড়ি পড়ে গেল। কিন্তু জানেন কী কোনও কোনও গল্পের শেষ নেই...তাদের শেষই শুরু...ঠিক বাচ্চাদেরকে গল্প বলার মতো...তাদের গল্পে কোনও শেষ নেই, শেষ থেকেই আবার নতুন গল্প শুরু হয়ে যায়। তা ওপরের ওই গল্পটার শেষ থেকেই আবার নতুন কাহিনি জন্ম নিতেই পারে। আবার নতুন করে নিজেদের গড়ে তোলার গল্পপয়লা বৈশাখকে একলা হতে না দেওয়ার গল্প। আর আবার নতুন করে নিজেদের গড়ে তোলার গল্পপয়লা বৈশাখকে একলা হতে না দেওয়ার গল্প।
আর গল্পই বা কেন বলছি। এ তো আমাদের নিজেদের জীবনেরই কাহিনি। এর থেকে চূড়ান্ত সত্য আর কী আছে? পরশু বাংলা নতুন বছরের শুরু।
১৪২১ সাল, পয়লা বৈশাখ, ইংরেজি পনেরোই এপ্রিল (ইংরিজি তারিখটা না জানলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা, বাংলা সন তারিখ গুলিয়ে যেতে পারে)। এই নতুন বছরের প্রথম দিনে আসুন না আমরা শপথ নিই আমাদের সাধের বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতিকে উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার। তবে এ ক্ষেত্রে মুম্বইয়ের অনেক বাঙালিই অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন। বাংলা নববর্ষ উদযাপন তো বটেই, এ ছাড়াও বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা, বাংলা ভাষা দিবস পালন, বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করে, ঘরোয়া সাহিত্য সভার আয়োজন ইত্যাদি। আসলে যতই পরবাসে থাকি, যতই চার পাশে মিশ্র সংস্কৃতির জয় জয়কার দেখি না কেন, নিজের শিকড়টাকে কি কেউ ভুলতে পারে?
এই যেমন বাংলা বছরের শুরুতে মুম্বই-নবি মুম্বই জুড়ে আমরা বেশ কয়েকটি বাংলা নাটক দেখতে চলেছি। আগের দুটি সংখ্যায় চেম্বুর ক্লাব ও ভাসাইয়ের বেসিন বেঙ্গল ক্লাবের নাট্যোত্সবের খোঁজখবর দিয়েছিলাম। এ বার বলব ‘দিশারী’র নাট্যোত্সব সম্পর্কে। নাট্যোত্সবের আগে ‘দিশারী’ নিয়ে দু’চার কথা বলে নিই।
১৯৮৬ সালে এই সংস্থার জন্ম এবং দীপায়ন গোস্বামী ও শাশ্বতী গোস্বামী এর কর্ণধার। মূলত আমাদের চার পাশে ঘটতে থাকা বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এই সংস্থার নাটকের উপজীব্য। ‘দিশারী’র দুটি বিভাগ আছে, নাট্য বিভাগ এবং নৃত্য বিভাগ। নাটকের মধ্যে আবার ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে শ্রুতি দৃশ্য নাটক। ‘জাদুঘর’ এই শ্রুতি দৃশ্য নাটকটি বহু প্রশংসিত হয় এবং ২০০৩ সালে ভাসির বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে ‘অনভিজ্ঞ ভূত’ শ্রুতি দৃশ্য নাটকটি অভিনীত হয়।
‘দিশারী’র এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে প্রায় পঞ্চাশটি নাটক ও কুড়িটি শ্রুতি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে রক্তকরবী, আন্তিগোনে, সম্প্রদান, মাউস ট্র্যাপ, শেষ নেই, চাক ভাঙা মধু এবং নৃত্যনাট্য অভিসার। মুম্বই, নবি মুম্বই, পুণে, কটক, ইলাহাবাদ, নাগপুর, লখনউ প্রভৃতি স্থানে ‘দিশারী’র নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এবং ঝুলি পূর্ণ হয়েছে নানা পুরস্কারে। কলকাতায় আন্তর্জাতিক গঙ্গা যমুনা নাট্যোত্সবে দু’বার অংশগ্রহণ করেছেন ‘দিশারী’র কলাকুশলীরা।
২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ‘দিশারী’র নাট্যোত্সবের সংগৃহীত অর্থ দান করা হয়েছে কুষ্ঠরোগীদের জন্য, অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাবাস এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘে।
এই বছর দিশারীর নাট্যোসব অনুষ্ঠিত হবে উনিশে এপ্রিল, শনিবার, নবি মুম্বই-এর ভাসির সেক্টর ছয়ে মরাঠি সাহিত্য মন্দিরে সন্ধে সাড়ে ছ’টায়। এ বারে দিশারীর নাটক দীপায়ন গোস্বামীর পরিচালনায় ‘পথে এ বার নামো সাথী’। নাটকটি নারী প্রগতির ওপর রচিত। দ্বিতীয় নাটকটি ‘বাবুদের ডালকুকুরে’। পরিবেশনায় বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, সানপাড়া। তৃতীয় নাটকটি চন্দননগরের ‘যুগের যাত্রী’ সংস্থার পরিবেশন ‘শেষের সে দিন’। নির্দেশনা রামকৃষ্ণ মণ্ডল। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, এই নাট্যোত্সবে সংগৃহীত অর্থ দান করা হবে নবি মুম্বই বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন, ভাসি-র ক্যানসার হোমে। তা হলে সুধিজন বাংলা নতুন বছরের শুরুতে আপনারা বাংলা নাটক দেখে নিজেদের সমৃদ্ধ করুন। কে বলে এই পরবাসে বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় ভাটা পড়েছে। নতুন বছরে বাংলা নাট্যোত্সব দিয়ে যার শুরু, সারা বছর আমরা যেন এ ভাবেই আমাদের জয়ধ্বজাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তবে মুম্বইয়ের নাট্যগোষ্ঠীগুলির প্রতি একটি অনুরোধ। তাঁরা যেন ছোটদের কথাও একটু ভাবেন। আজকাল ছোটরাই মনে হয় বাড়িতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবারে সব থেকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটায়। দাদু, দিদা, ঠাম্মারা কেউ নেই। নেই তাদের রূপ কথার গল্প বলার লোক। তাদেরও তো একটু মনের খোরাক দরকার। তাই করুন না আপনারা ছোটদের জন্য কোনও প্রযোজনা যাতে তারা একটু আনন্দ পায়। তাদেরও তো ইচ্ছে করে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে কোনও রূপকথার রাজ্যে পাড়ি দিতে।
অনেক কিছু লিখে ফেললাম। এ বার শেষ করার পালা। আগাম শুভ নববর্ষ। বাংলা নতুন বছর সকলের খুউব ভাল কাটুক।