সোশ্যাল মিডিয়ার রাশ নিয়ে চিন্তায় কমিশন

সোশ্যাল মিডিয়াই মাথাব্যথা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে একে নিয়ে কী ভাবে কী করবে, ভেবে পাচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। কেন? জনজীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তার ক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।

Advertisement

কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২০:১৫
Share:

সোশ্যাল মিডিয়াই মাথাব্যথা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে একে নিয়ে কী ভাবে কী করবে, ভেবে পাচ্ছে না নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

কেন? জনজীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তার ক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। বড়-ছোট বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাই এখন টুইটার-ফেসবুকে নিয়মিত বক্তব্য রাখছেন। রাজনীতি নিয়ে গরমাগরম বিতর্কে মাতছেন নেটিজেনরা। আম আদমি পার্টির উত্থানে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা স্বচক্ষে দেখেছে নির্বাচন কমিশন। এখন ঘটনা হল সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলির জন্য নির্বাচনী আচরণবিধি রয়েছে। বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম এবং মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমকেও আচরণবিধির মধ্যে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কোনও আইন নেই। কী ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব, তা নিয়ে কথা বলতে দেশের প্রতিটি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারদের ১০ তারিখ বৈঠকে ডেকেছে কমিশন।

বসে নেই রাজনৈতিক দলগুলোও। লোকসভা ভোটে ঝাঁপানোর আগে সোশ্যাল মিডিয়াকে কী ভাবে কাজে লাগানো হবে, তার নীতি ঠিক করতে এখন ব্যস্ত তারা। এবং এই একটি ব্যাপারে তৃণমূল-সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেসে কোনও ভেদ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, নিশ্চিত ভাবেই এ বারের লোকসভা ভোটে সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে তাঁর দল কাজে লাগাবে। প্রয়োজনে ওই মিডিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত বক্তৃতাও প্রচার করা হবে। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় স্তর থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দক্ষ কর্মীদের নিয়ে প্রচারদল গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মনে করাচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদীর ইমেজ তৈরির ক্ষেত্রে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। একদা কম্পিউটার-বিরোধী সিপিএমও পিছিয়ে নেই। রবীন দেবকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হবেই। তবে কী ভাবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

Advertisement

এই আবহে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। যেমন, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যদি প্রচার চলতে থাকে, তার উপর রাশ টানা হবে কী করে? এই উদ্বেগের শরিক অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলিও। পার্থ-মানস-রাহুল তিন জনেই প্রশ্ন তুলছেন, প্রচারবিধি লঙ্ঘন করে যদি কেউ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তা হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ১০ তারিখের বৈঠকে তার উত্তর খুঁজবে কমিশন।

আরও সমস্যা আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। দরকার শুধু একটি মোবাইল নম্বর। ভোটের সময় প্রার্থী ও রাজনৈতিক পদাধিকারীদের মোবাইল নম্বর প্রায়ই গোপন থাকে না। সে ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি যদি কোনও প্রার্থীর মোবাইল নম্বর দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার শুরু করেন, তা হলে কি সংশ্লিষ্ট প্রার্থী অভিযুক্ত হবেন? প্রার্থীর বিরুদ্ধে কুৎসা বা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করলে কাকে শাস্তি দেবে নির্বাচন কমিশন? প্রার্থী বা দল যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে, তা হলে তার পরিণাম কী হবে? সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিধি-ভঙ্গকারী মন্তব্য করার জন্য নরেন্দ্র মোদী, রাহুল গাঁধী, জয়ললিতার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছে কমিশন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ধরনের প্রচার হলে কী করা হবে? এই সব প্রশ্ন এখন উঁকি দিচ্ছে কমিশনের মনে।

তার পর আছে খরচের প্রশ্ন। কমিশনের নির্দেশে প্রার্থীদের প্রচারের খরচ বেঁধে দেওয়া আছে। এমনকী কোনও প্রার্থীর খরচের কোন অংশ তার নিজস্ব নির্বাচনী খরচ হিসাবে ধরা হবে আর কোনটা রাজনৈতিক দলের খাতে ধরা হবে তারও নির্দেশিকা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের হিসেব কী হবে? সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বক্তব্য পোস্ট করায় এমনি কোনও খরচ নেই। সে ক্ষেত্রে যে দল যত লোক জোগাড় করতে পারবে, তত বেশি পোস্ট করবে! এমনকী পয়সা দিয়ে লোক ভাড়াও করা হতে পারে পোস্ট করার জন্য! কমিশন সেটা ধরবে কী করে? আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, আপাতত প্রচারমূলক পোস্ট-এর সংখ্যা হিসেব করে তার উপর মূল্য ধার্য করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে। আবার এমন যদি হয়, কেউ কোনও দল বা প্রার্থীর অনুগামী। কিন্তু ওই প্রার্থী বা দল সেই ব্যক্তিকে চেনে না। সে ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের খরচ কার উপর বর্তাবে? উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়।

তেমনই স্পষ্ট নয় সোশ্যাল মিডিয়ার সংজ্ঞাও। অনেকেরই মত হল, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিগত মত প্রকাশের জায়গা। দলীয় বা সাংগঠনিক পরিচয়-প্রতীক ছাড়া যদি কেউ নিজস্ব মতামত পোস্ট করেন, তা নিয়ে কমিশন কি কিছু বলতে পারে? কমিশন কি এমন কোনও ফরমান দিতে পারে যে, ভোটের আগের ৪৮ ঘণ্টা কেউ কোনও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করতে পারবেন না ফেসবুক বা টুইটারে? যদি এমন কোনও ফরমান আসেও, তা হলেই বা সেটা কার্যকর করা যাবে কী করে? কারণ, একটি দফার ভোটে প্রচারপর্ব যখন শেষ হচ্ছে, অন্যান্য এলাকার ভোট-প্রচার তখনও চালু। ফেসবুক পোস্টকে তো ভূগোলে বাঁধা যায় না। সে ক্ষেত্রে এক এলাকার প্রচারের ছবি বা কথা অন্য এলাকাতেও পরোক্ষ প্রভাব ফেলতেই পারে!

নেটিজেনদের একাংশ এ কথাও বলছেন যে, নির্বাচনী বিধি দল, সরকার বা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি নাগরিককে চুপ করানো যাবে কী করে? প্রচারপর্ব মিটে গেলেও ঘরোয়া আলোচনায়, পাড়ার ক্লাবঘরে, পরিচিত জটলায় কি বেড়ি পরানো যায়? তা হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোপ পড়বে কেন?

এ ক্ষেত্রে কমিশনের বক্তব্য হল, পাড়ার আড্ডা আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কের দেওয়াল এক নয়। দুয়ের প্রভাব এবং পরিধিতে আকাশপাতাল তফাৎ আছে। ফেসবুক পোস্টও ঘরোয়া আলোচনা নয়, সেটা একটা প্রকাশ্য অবস্থান। ইন্টারনেট সমীক্ষণ সংস্থা কমস্কোর-এর হিসেব বলছে, ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া সদস্য হয়েছেন এবং তাঁরা সেখানে নিয়মিত তাঁদের মতামত জানিয়ে থাকেন। সুতরাং এটাকে উপেক্ষা করার জায়গা নেই। কমিশন সূত্রের খবর, এখনই নতুন আইন আনার কথা না ভাবলেও ভোট-পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করা হবে, সেটাই ভাবাচ্ছে কমিশনকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন