শরিফুদ্দিনের দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজনরা। রবিবার করিমগঞ্জে। ছবি: উত্তমকুমার মুহুরী।
গণপ্রহারে শরিফুদ্দিনের মৃত্যু ও অভিযোগকারিণীর সাক্ষাৎকারের ভিডিও নিয়ে অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতি রুখতে ৪৮ ঘণ্টার জন্য রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের নির্দেশ দিল নাগাল্যান্ড সরকার। নিষেধাজ্ঞা বহাল হয়েছে এসএমএস-এর উপরেও। পাশাপাশি বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ২২ জনকে।
শরিফুদ্দিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে বলে নিহতের পরিজন-সহ বিভিন্ন মহল দাবি তুলেছে। একই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত রাতে অভিযোগকারিণী তরুণী সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দ্রুত সেই ভিডিও ছড়াতে থাকে। ‘আপলোড’ করা হয় গণপিটুনিতে শরিফুদ্দিনকে খুনের ছবিও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের নির্দেশ দেয় নাগাল্যান্ড সরকার। মুখ্যমন্ত্রী টি আর জেলিয়াং বলেন, “রাজ্য সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে নয়। কিন্তু ইন্টারনেটে প্ররোচনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হলে, হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়।” রাজ্য পুলিশের আইজি ওয়াবাং জামির জানান, গণপ্রহার ও জেল ভাঙার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিমাপুরে জারি রয়েছে ১৪৪ ধারা। তবে, এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় জেলকর্মীদের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। গণপিটুনিতে মৃত্যুর পর শরিফুদ্দিনকে যেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্লক টাওয়ারের সামনে আজ বিকেলে মোমবাতি হাতে নিয়ে মিছিল বের করার উদ্যোগ নিয়েছিল একটি সংখ্যালঘু সংগঠন। পুলিশ তার অনুমতি দেয়নি। পুলিশ সূত্রে খবর, কোন মহলের প্ররোচনায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটল, তার তদন্তে নাগাল্যান্ডে যেতে পারে এনআইএ।
ডিমাপুরে খুন হওয়া ভূমিপুত্র শরিফুদ্দিনকে এ দিন বিদায় জানালেন বরাকবাসী। করিমগঞ্জের গ্রামে তাঁর শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন হাজার তিনেক মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। নাগাল্যান্ড সরকারের পাঠানো একটি নোট নিয়ে সেখানে ক্ষোভ ছড়ায়। শরিফুদ্দিনের দেহের সঙ্গে পাঠানো ওই নোটে শুধু নিহতের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল। জনতা দাবি তোলে, ওই কাগজে খুনের উল্লেখ থাকতে হবে। একই বক্তব্য ছিল নিহতের পরিজনদের। আওয়াজ ওঠে সংশোধিত নোট ছাড়া শরিফুদ্দিনের শেষকৃত্য করা যাবে না। পরিস্থিতি সামলাতে এ নিয়ে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন দক্ষিণ করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক সিদ্দেক আহমেদ, জেলা এআইইউডিএফ সভাপতি আব্দুল মালিক চৌধুরী। প্রশাসন আশ্বাস দেয়, নাগাল্যান্ডের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি নিয়ে আসা হবে। এর পরই জানাজার নমাজ পড়া হয়। মসজিদেরপাশে কবরস্থানে অন্তিমসজ্জায় শায়িত হন শরিফুদ্দিন।
ডিমাপুরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এ দিন বরাক উপত্যাকার জনজীবন স্তব্ধ ছিল। কোথাও কোনও ঝামেলা না হলেও, বিভিন্ন জায়গায় নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। শরিফুদ্দিনের খুনের প্রতিবাদে হাইলাকান্দি জেলার দশটি সংগঠন জোট বেঁধেছে। অসম ও নাগাল্যান্ডের রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে তারা জেলিয়াং সরকারকে বরখাস্ত করার দাবি জানাবে। যৌথমঞ্চের তরফে আগামী কাল জেলায় কালা-দিবস পালনেরও ডাক দেওয়া হয়েছে। দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটি। ডিমাপুর মুসলিম কাউন্সিল এ দিন একটি আবেদনে জানায়, শরিফুদ্দিনের খুন একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নাগাল্যান্ডে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে এমন গুজবে কান দেওয়া উচিত নয়। একে ‘অস্ত্র’ করে অসমে জেহাদি শক্তিগুলি ফের সক্রিয় হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার জেরে ভয়ে ডিমাপুর ছাড়ছেন অ-নাগা বাসিন্দারা। তাতে সামিল করিমগঞ্জ জেলার মানুষও। বেশির ভাগই দিনমজুর, দোকানের কর্মী। এ দিনও করিমগঞ্জে পৌঁছেছেন জনাপঞ্চাশ মানুষ। কিন্তু কেউই মুখ খুলতে নারাজ। কয়েক জন জানান, শরিফুদ্দিনের খুনের মতো নৃশংস ঘটনা আগে না ঘটলেও, অ-নাগাদের উপর মাঝেমধ্যেই হামলা হয়। এক মহিলা বলেন, “এখন পালিয়ে এলেও ফিরে তো যেতেই হবে। না হলে খাবার জুটবে না!”