Liberal Arts Education

নতুন দরজাটা খুলতে হবে

দিন পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে প্রযুক্তিশিক্ষার বাজারও। সময় আসছে লিবারাল আর্টস এডুকেশনের। এই নতুন ধারার শিক্ষা আমাদের নতুন জগতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করে। গল্প লেখা, ভিডিয়ো গেম বানানো, ইন্টারনেটে গবেষণা করা— আগে যা নেহাতই শখের ব্যাপার ছিল, সেগুলো এখন পেশা হয়ে উঠছে।

Advertisement

সুপ্রিয় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

সময় পাল্টাচ্ছে, শিক্ষার দুনিয়াটাও পাল্টাচ্ছে। কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং— তোমাদের অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে এত দিন ছিল সহজ ফর্মুলা। এখন কিন্তু সেটা পাল্টানোর সময়। আমাদের দেশটা আউটসোর্সিং-এর সুযোগ নিয়ে পাল্টেছে অনেক, এ দিকে তার মধ্যে এসে পড়েছে কোভিডের ওলোটপালট। ট্রাম্প-ব্রেক্সিটের বাজারে ওই রকম ব্যবসার সুযোগ অনেক কম, কিন্তু তার থেকেও বেশি মাত্রায় পরিবর্তন আসছে প্রযুক্তিতে আর ব্যবসার ধরনে। ভারতীয় সংস্থাগুলো এত দিন ‘বডি-শপিং’ করে খুব সফল হয়েছে। কিন্তু আগেকার কাজের ধরন— কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা, অ্যাকাউন্টস বানিয়ে দেওয়া, গ্রাহক-সেবা, এ সব এখন অনেকটাই যন্ত্র দিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

ভাল খবর হল যে, নতুন প্রযুক্তি যেমন এক হাতে নেয় তেমনই আর এক হাতে দেয়। ফলে নতুন নতুন পেশার সুযোগ তৈরি হচ্ছে এক সঙ্গেই। গল্প লেখা, ভিডিয়ো গেম বানানো, ইন্টারনেটে গবেষণা করা— আগে যা নেহাতই শখের ব্যাপার ছিল, সেগুলো এখন পেশা হয়ে উঠছে। আর তাই, এই নতুন সুযোগগুলোকে বুঝতে, নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে, তোমরা নিজেরা স্নাতক স্তরে লিবারাল আর্টস এডুকেশন নিয়ে পড়াশোনা করার কথা ভাবতেই পারো।

Advertisement

নতুন পথ চাই

এই শিক্ষার ধারা আমেরিকা থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। আমাদের দেশে গত তিরিশ বছরে প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে এলেও, এখন ধারণাটা পাল্টাচ্ছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা যে নতুন শিক্ষানীতি অনুমোদন করলেন তার মূল বার্তা হল, এখন সময় এসেছে লিবারাল আর্টস এডুকেশন-এর! প্রযুক্তির অগ্রগতি যে একটা অন্য পরিবেশ তৈরি করেছে এবং এক মাত্র লিবারাল আর্টস এডুকেশনই আমাদের এই নতুন অর্থনীতির সুযোগ দিতে পারে, এই শিক্ষানীতি এক ভাবে সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্নে হাঁটার দিন শেষ— নতুন রাস্তা খুঁজতেই হবে আমাদের।

বিষয়টা কী?

লিবারাল আর্টস এডুকেশন বলতে আমরা কী বুঝি, তাই নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কিছু আধুনিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিবারাল আর্টস এডুকেশনকে আমেরিকায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনার প্রস্তুতি হিসাবে দেখানো হয়— জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বিলাসবহুল শিক্ষার এক পথ হিসেবে। বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, লেখক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাপুরুষদের অন্যতম বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন এই ধরনের শিক্ষাকে মজা করে ‘খাবার টেবিলে ছুরি-কাঁটা ধরার শিক্ষা’ বলতেন। এই ধরনের শিক্ষা নিশ্চিত ভাবেই লিবারাল আর্টস এডুকেশন নয়, এর মধ্যে মনকে বিস্তৃত করার, বাস্তব জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার এবং বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের মোকাবিলা করার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই।

আবার, কেউ কেউ লিবারাল আর্টস এডুকেশন বলতে ভাবেন, ভারতীয় ঐতিহ্যের শিক্ষা। এই ভাবনাটাও ঠিক নয়। নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এই শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু লিবারাল আর্টস এডুকেশন তো শুধু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা হতে পারে না। এর মূল চরিত্র হল কৌতূহল— জীবন সম্বন্ধে, পৃথিবী সম্বন্ধে, সমস্ত স্বীকৃত ধারণা সম্বন্ধে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লিবারাল আর্টস এডুকেশন-এর ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু তার লক্ষ্য আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংযোগ। উদার হতে গেলে লিবারাল আর্টস এডুকেশনকে তো সব দেশের ধারণাকে জানতে এবং নিেজর মধ্যে গ্রহণ করতে হবে।

পরে কী করতে পারো

• ডিজিটাল ও নন-ডিজিটাল মিডিয়া কিংবা এন্টারটেনমেন্ট সেক্টরে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ। এডিটিং, কনটেন্ট রাইটিং, কনটেন্ট প্রোডিউসার ইত্যাদি।

• প্রোডাক্ট ডিজ়াইনার, প্রোডাক্ট ম্যানেজার।

• বিজ়নেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে মার্কেটিং স্পেশালিস্ট। কিংবা মার্কেট রিসার্চার।

• শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজ।

• সমাজসেবা ও গঠনমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ।

যে যাই ভাবুক, লিবারাল আর্টস এডুকেশন হল বইবন্দি শিক্ষার থেকে মুক্তি। পুরনো কালে ব্রিটিশ রাজ ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষাপন্থায় বার্ক, বেনথাম আর মিল-সহ সেই সময়ের ব্রিটিশ সংস্কারকদের লেখা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের শিক্ষায় এই সব পরিবর্তনবাদী ধারণার কোনও জায়গা ছিল না। তাই ভারতীয় শিক্ষায় বইয়ের, বিশেষত ইংরেজি বইয়ের, একটা বিশেষ জায়গা আছে। ছাত্রদের মুখস্থ করতে শেখানো হয়, আলোচনা করতে, ভাবতে বা প্রশ্ন করতে শেখানো হয় না। ব্রিটিশ-বিদায়ের পরেও কিন্তু সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। আমার স্কুল-জীবনের এক শিক্ষক বলতেন,“ওরে ইংরেজি ভাষায় ছাপা অক্ষরে থাকলেই কোনও কিছু ধ্রুব সত্য হয়ে যায় না।” একই ভাবে, ইংরেজির বদলে সংস্কৃত, আরবি বা বাংলা আনলেই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। না, বই মুখস্থ নয়, জীবনমুখী শিক্ষা, কৌতূহল জাগানো শিক্ষাই হল লিবারাল আর্টস এডুকেশন-এর মূল কথা।

এই শিক্ষা সম্বন্ধে আর একটা প্রচলিত ধারণা হল যে এটা নানা বিষয়ের পাঁচমিশেলি— কিছুটা সাহিত্য, কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা বিজ্ঞান, কিছুটা মনস্তত্ত্ব, এই রকম। ধারণাটা ভুল। লিবারাল আর্টস এডুকেশন হল মানুষ হওয়ার শিক্ষা। এর উদ্দেশ্য হল জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো, একই সঙ্গে সমস্ত বিষয়ের একে অপরের সঙ্গে যে যোগ রয়েছে, সেটাকেও স্পষ্ট করে তোলা।

শিক্ষার লক্ষ্য

বলতে পারি, প্রথমত, এই শিক্ষা মুক্তির শিক্ষা— নিজেদের মতো করে ভাবতে, প্রশ্ন করতে, জগৎকে নিজের মতো করে জানতে শেখানোর শিক্ষা। মার্কিন সমাজ সংস্কারক ও কূটনীতিবিদ ফ্রেডরিক ডগলাস লিখেছিলেন, লিবারাল আর্টস এডুকেশন তাঁকে দাসত্ব মেনে নিতে অক্ষম করেছে। ধারণার মুক্তি, কল্পনার মুক্তি, সৃষ্টির মুক্তি— আজকের পরিবর্তনশীল সময়ে একটা বড় সম্পদ।

দ্বিতীয়ত, লিবারাল আর্টস এডুকেশন আমাদের সঙ্গে চারপাশের সম্পর্কটা পাল্টে দেয়। সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া, দৈনন্দিন জীবনে তাকে আবিষ্কার করা সুস্থ সুখী জীবনের পূর্বশর্ত। আমাদের গতানুগতিক জীবনের মধ্যে সৌন্দর্যকে অনুভব করা একটা জরুরি পদক্ষেপ।

তৃতীয়ত, এই শিক্ষা আমাদের একে ওপরের সঙ্গে বাঁচতে শেখায়। আধুনিক জীবনের স্বার্থপর ইঁদুরদৌড়ে, রাজনৈতিক বিভাজনে, আমাদের সামাজিক জীবন আজ জর্জরিত। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন গভর্নর এবং অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজনের ভাষায়, ‘সামাজিক জীবন আমাদের আধুনিক জীবনের তৃতীয় স্তম্ভ— রাষ্ট্র এবং বাজারের সঙ্গে সমান গুরুত্ব তার’। লিবারাল আর্টস এডুকেশন শুধু প্রশ্ন এবং তর্কই করতে শেখায় না, অন্যের মতামতকে, জীবনধারাকে মর্যাদাও করতে শেখায়।

শেষে কিছু কথা

লিবারাল আর্টস এডুকেশন দিয়ে আমরা নতুন ভাবে জীবনে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারি। প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের সাজানো জীবন ওলোটপালট করে দিচ্ছে। আমরা এই পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের কাজে লাগাতে পারব, না এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে নিজেদের ঠেলে দেব, সেটা কিন্তু নির্ভর করবে আমাদের বোধবুদ্ধি দিয়ে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি কি না, তার ওপর। লিবারাল আর্টস-এর শিক্ষা হল সেই বোধবুদ্ধি বাড়ানোর শিক্ষা।

আমি যখন কলেজে পড়তে যাই, তখন ভেবেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ আমি ভালই ছকে নিয়েছি। কোন পেশায় থাকব, কোথায় থাকব— সব কিছুর পরিকল্পনা করা ছিল। কিন্তু সেই সবের কোনও কিছুই বাস্তবে হয়নি। ইন্টারনেট আর বিশ্বায়নের কারণে জীবন নতুন রাস্তায় চলেছে।

ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস বলেছিলেন, “সভ্যতা হল শিক্ষা আর বিপর্যয়ের মধ্যে এক দৌড়।” এখন করোনা-প্রকোপের মধ্যে বিশ্বে ব্যাপক এক অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসতে চলেছে। আর আসছে নতুন সুযোগ। কিন্তু পুরনো ভাবনা নিয়ে চললে এই নতুন সুযোগের দরজা খুলবে না। লিবারাল আর্টস এডুকেশন-এর সুযোগ নিয়ে তোমাদের এ বার সেই দরজা খুলতে হবে।

শিক্ষা-উদ্যোগপতি এবং গবেষক, ইউ কে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন