Coronavirus

ওদের ঠিক রাখার দায়িত্ব আমাদেরই

অতিমারি পরিস্থিতি সারা জীবন থাকবে না। আবার ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে ফিরবে। এখন থেকে তাদের এই মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করা না গেলে পরবর্তী কালে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে।

Advertisement

সুরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২০ ০০:০৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

এই অতিমারি পরিস্থিতিতে আমরা ভাবছি, স্কুল-কলেজের মাইনে কী ভাবে মকুব করা যাবে, প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলবে, ক্লাস কী করে করা যাবে। কিন্তু বড় একটা বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে— ছেলেমেয়েদের মানসিক অবস্থা। স্কুল-কলেজ বন্ধ, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কোনও দেখাসাক্ষাৎ নেই, সারা ক্ষণই প্রায় বাড়িবন্দি। তার ওপর টিভি, সংবাদমাধ্যম, তার খবর— আক্রান্তের সংখ্যা এত বাড়ল, এত জন মারা গেলেন ইত্যাদি। চার দিকে একটা দমবন্ধ ভাব, চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেমেয়েরা একই মানুষের মুখ দেখছে, যেটা তারা দেখতে অভ্যস্ত নয়। ছাত্রজীবনের মূল ধারাটাই হল, খেলাধুলো, আড্ডা, বেড়াতে যাওয়া, শিক্ষা পাওয়া— সব কিছু একসঙ্গে করা। এর মাধ্যমেই তাদের জীবন সম্পর্কে ধারণা জন্মায়, উদ্ভাবনী শক্তি ও চিন্তাশীলতা বাড়ে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটার সঙ্গে গত মার্চ মাস থেকে বিচ্ছিন্ন ছাত্রছাত্রীরা, আর তার ফলে অনেকেই মানসিক চাপে ভুগছে।

Advertisement

অতিমারি পরিস্থিতি সারা জীবন থাকবে না। আবার ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে ফিরবে। এখন থেকে তাদের এই মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করা না গেলে পরবর্তী কালে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে। বড়দের, ছোটদের সকলকেই কথাটা মনে রাখতে হবে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ইংরেজিতে জুনিয়র স্টেটসম্যান নামে একটি কাগজ বেরোত। আমাদের অনেকের লেখার হাতেখড়ি ওই পত্রিকায় লেখার মধ্যে দিয়ে হয়েছে। আজকের দিনে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক কোনও মাধ্যমেই ছোটদের উপযোগী প্ল্যাটফর্ম নেই, যেখানে তারা নিজেদের ভাবনাচিন্তা খোলা মনে আলোচনা করতে পারে। শিশুসাহিত্যেরও তথৈবচ অবস্থা। সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকার কথা মনে পড়ে। বিদেশে কিন্তু শিশুসাহিত্যকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এমন কিছু চালু না হলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নেতিবাচক ভাবনা বাড়বে।

Advertisement

পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে কোনও বিপর্যয়ের শেষেই একটা রুপোলি রেখা থাকে। যেমন, প্লেগ না হলে প্লেগের টিকা বেরোত না, ম্যালেরিয়া না হলে ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হত না। এই নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের চেষ্টা করতে হবে ছোটদের কাছে এই কথাগুলো বলার। অনেক জায়গাতেই দেখছি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা সামাজিক কাজকর্মে যোগ দিচ্ছে। গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে সমাজের কাছে আশার আলো দেখানোর চেষ্টা করছে। এই ধরনের কাজ করলে, গল্প-উপন্যাস পড়ার প্রবণতা বাড়লে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনাচিন্তাও বাড়বে।

অতিমারি পরবর্তী পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে একটা নতুন জগতে প্রবেশ করতে চলেছে, যেটা আগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা চাই বা না চাই, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হতে চলেছে, শিক্ষার পদ্ধতিও পাল্টে যাবে। কাজেই ছেলেমেয়েদের এ সব কাজে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আগামী দিনে প্রতিযোগিতা এতটাই বেড়ে যাবে, আপস্কিলিং ছাড়া নিজেদের বাজারে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এর জন্য এখন থেকেই তাদের তৈরি হওয়া দরকার।

এটা এক দিক থেকে ভয়ের কথাও। শিক্ষাক্ষেত্রে এতটা প্রযুক্তিনির্ভরতার ফলে হিউম্যানিটিজ়, লিবারাল আর্টসের মতো বিষয়গুলি ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে পারে। আমার আশঙ্কা, তাতে এমন ছাত্রসমাজ তৈরি হবে যারা খালি বাজারি অর্থনীতিতেই কাজ করতে পারবে, সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না। অথচ উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, ঠিকঠাক নাগরিক তৈরি করা, যারা দেশ গঠনে উৎসাহী, নতুন পৃথিবী গড়তে উন্মুখ। আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে এই পথ থেকে সরে না আসে, অতিমারির আবহে সেটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের। সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক— সকলের।

উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন