শেফালী জরীওয়ালার বর্তমান স্বামী পরাগ ত্যাগী। হরমিত সিংহের সঙ্গে পাঁচ বছরের দাম্পত্য ভেঙেছিল ২০০৯ সালে। ছবি: সংগৃহীত।
বছর ৪২-এর অভিনেত্রী শেফালী জরীওয়ালার আকস্মিক মৃত্যু এই মুহূর্তে শিরোনামে। হার্ট অ্যাটাক, না কি রক্তচাপ কমে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। ‘কাঁটা লাগা’ গানের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পীর জীবন যে এ ভাবে শেষ হতে পারে, তা যেমন তাঁর অনুরাগীরা মানতে পারছেন না, ঠিক তেমনই শোকে ভেঙে পড়েছেন তাঁর স্বামী পরাগ ত্যাগীও। মন ভাল নেই শেফালীর প্রাক্তন স্বামী হরমিত সিংহেরও।
এখন ইউরোপে হরমিত। বহু দিন হল শেফালীর সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন হয়েছে তাঁর। তবে এমন ঘটনা শোনার পর তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন। ইনস্টাগ্রামে সে কথাই জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার জীবনের অন্যতম বেদনাদায়ক মুহূর্ত। অতীতে আমরা অনেক ভাল মুহূর্ত একসঙ্গে কাটিয়েছি। সেই সবই মনে রয়ে যাবে।’’ শেফালীর বাবা-মা এবং বর্তমান স্বামীকে সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
সঙ্গীত প্রযোজক হরমিত সিংহের সঙ্গে ২০০৪ সালে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন শেফালী। মাত্র পাঁচ বছরেই তিক্ততা দিয়ে সেই সম্পর্ক শেষ হয়। বিচ্ছেদের পূর্বে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেওযার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে অসুখী দাম্পত্যের কথাও জানান শেফালী।
অথচ এক সময়ে মডেল-অভিনেত্রীর মনে হয়েছিল, এই বিচ্ছেদের পর তাঁর পক্ষে আর কাউকে ভালবাসা সম্ভব হবে না, বিয়ে দূরের কথা। বিবাহবিচ্ছেদের পরে লোকে তাঁর দিকেই আঙুল তুলেছিলেন। ‘‘‘কাঁটা লাগা’র মতো নাচ করা মেয়েরা এমন হয়’— এ কথাও শুনতে হয়েছিল তাঁকে।
এক সক্ষাৎকারে শেফালী বলেছিলেন, ‘‘এক সময় মনে হয়েছিল, এখানেই বুঝি সব শেষ।’’ তবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী। ২০১৪ সালে অভিনেতা পরাগ ত্যাগীকে বিয়ে করেন তিনি।
বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন— কখনও কখনও মনে হয়ে, সবই বুঝি শেষ। ভেঙে যায় বিশ্বাস। ভালবাসা থেকে আস্থা উঠে যায়। ঠিক যেমনটা হয়েছিল শেফালীর ক্ষেত্রে। আবার ধীরে ধীরে সব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে এক সময় নতুন জীবনও শুরু করতে পেরেছিলেন তিনি। এমন কেন হয়?
মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার জানাচ্ছেন, ‘‘মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলা হয় ‘ডাবডা’। সুইস-আমেরিকান মনোরোগ চিকিৎসক এলিজ়াবেথ কুবলের রস এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন। এই ডাবডার শুরু হয় ডিনায়্যাল বা মানতে না পারা থেকে। কোনও পক্ষ অন্যের থেকে যে ভালবাসা আশা করছেন, সেটা না পেলে তৈরি হয় কষ্ট। কোনও এক পক্ষ বিশ্বাসঘাতকতা করলে বা দূরে সরে গেলে, তা মেনে নেওয়া অসম্ভব বোধ হয়। ডিনায়্যাল থেকেই আসে অ্যাঙ্গার বা রাগ। তার পরই আসে বার্গেনিং বা দ্বন্দ্ব। অন্য পক্ষ কি পাল্টে যাবে, আবার জীবনে ফিরে আসবে? কখনও মনে হয়, যা ঘটছে, সবটা কি বাস্তব? দোদুল্যমানতা চলতে থাকে মনে। এই সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় তৈরি হতে পারে ডিপ্রেশন বা অবসাদ। একদম শেষ ধাপে থাকে অ্যাকসেপটেন্স বা বাস্তবকে গ্রহণ।’’
মনোরোগ চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখতে না পারা বা হঠাৎ করেই জীবন শেষ বলে মনে হওয়া আদতে তৈরি হয় অবসাদ থেকে। এমন সময়েই কারও কারও মনে হয়, সবই বুঝি শেষ। কারও জীবনে সেটাই মারাত্মক আকার নেয়। বাঁচার ইচ্ছা চলে যায়। কেউ কেউ চরম পথও বেছে নেন। শেফালীর এমন মনে হওয়াটা অবসাদ থেকেও হতে পারে। আবার অবসাদের সময়টা কেটে গেলে লোকে বাস্তবের সম্মুখীন হন। যাঁর সঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর জীবনে কোনও দিনই ফিরবেন না, এটা এক সময় মেনে নেয় মন। বাস্তবকে গ্রহণ করতে পারলেই ধীরে ধীরে জীবন ছন্দে ফেরে। জীবনে ভালবাসা ফিরে আসা, নতুন করে কারও হাত ধরা— এই সবই সম্ভব হয় বাস্তবকে মেনে নেওয়ার পরে।
মনোবিদ অতুল রাজ এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘‘সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানেই কিন্তু ভালবাসা হারিয়ে যাওয়া নয়। বরং এর অর্থ, দু’জন মানুষ কোনও কারণে পরস্পরের সঙ্গে থাকতে পারছেন না।’’ তাঁর মতে, সম্পর্কে ভাঙনের পরে নতুন করে প্রেমে পড়ার মতো অনুভূতির খোঁজেই ছিল মন। অনেকেরই ভালবাসা বা অন্যের উপর বিশ্বাসও উঠে যায়। তবে সেই ভয়কেই কাটিয়ে ওঠা দরকার।
যদি এই ভয় বা অবসাদ নিজে থেকে সামলে ওঠা সম্ভব না হয়, তা হলে চিকিৎসের পরামর্শ নেওয়াই ভাল। কিন্তু অবসাদে ভোগা একজন মানুষ নিজে থেকেই মনোবিদের কাছে বা মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাবেন, এমন তো নয়? শর্মিলা বলছেন, ‘‘বিচ্ছেদের পর কেউ যদি বার বার মৃত্যুর কথা পরিজন বা বন্ধুবান্ধবকে বলেন, বাড়ির লোকের সতর্ক হওয়া দরকার। অবসাদ প্রগাঢ় হলে কারও মধ্যে আত্মহননের প্রবণতাও জাগে। চিকিৎসায় তা আটকানো যায়।’’ এমন সময় পরিবার, পরিজনের সমর্থনও অনুঘটকের কাজ করতে পারে।