রোগী দেখছেন একমাত্র চিকিৎসক ধুরমল কিস্কু। ছবি: সমীর দত্ত।
রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে জঙ্গলমহলের সার্বিক উন্নয়ন। কিন্তু পুরুলিয়া জেলার একসময়কার মাওবাদী উপদ্রুত সেই বান্দোয়ানের ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে একমাত্র চিকিৎসকের ভরসায়। প্রায় একমাস ধরে এমনই অবস্থা চলছে। টানা রোগী দেখার ধকল সামলাতে না পেরে মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন একমাত্র চিকিৎসক ধুরমল কিস্কু। বাসিন্দাদের দাবি, এই সঙ্কট কাটাতে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। তাঁদের আশঙ্কা, যে কোনও সময় বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র অচল হয়ে পড়তে পারে।
বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, মাসখানেক আগে পর্যন্ত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্লক মেডিক্যাল অফিসার (বিএমওএইচ) অবিনাশ বেসরা-সহ তিনজন চিকিৎসক ছিলেন। অবিনাশবাবু চলতি বছরের ২৬ মার্চ অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। ওই পদে এখনও পর্যন্ত কেউ যোগ দেননি। অবিনাশবাবু ‘রিলিজ’ নিয়ে যাওয়ার সময় দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে যান চিকিৎসক জয়দেব সোরেনকে। তিনি কিছু দিন ভারপ্রাপ্ত ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের সাময়িক দায়িত্ব সামলান। তিনি আবার স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য প্রায় দিন দশেকের জন্য বাইরে চলে যান। তখন থেকেই চিকিৎসক সঙ্কট আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। তিনি কিছুদিন পরে ফিরে এলেও ফের তাঁকে দিল্লিতে একটি প্রশিক্ষণের জন্য এক সপ্তাহ আগে পাঠানো হয়েছে। ফলে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অন্তর্বিভাগ থেকে বহির্বিভাগ— সবই সামলাতে হচ্ছে ধুরমলবাবুকে। তিনি বলেন, ‘‘খুব চাপ যাচ্ছে। টানা ডিউটি করায় আমিও অসুস্থ বোধ করছি। ক’দিন সামাল দিতে পারব জানি না।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুমোদিত শয্যা ৩০টি থাকলেও ৭৫-৮০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া বর্হিবিভাগে দৈনিক ২৫০-৩০০ রোগী আসেন। আশপাশের গ্রাম থেকে বান্দোয়ানে বহু মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন। লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকেও অনেকে আসেন। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুমোদিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৬। কিন্তু তাঁর মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল তিনজনকে। কিন্তু এখন দু’জন রয়েছেন। তাও একজনকে মাঝেমধ্যেই নানা কারণে বাইরে থাকতে হচ্ছে।
বর্তমান চিকিৎসক ধুরমলবাবু বলেন, ‘‘এই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’জন চিকিৎসক রয়েছেন। তার মধ্যে জয়দেববাবু প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লি চলে যাওয়ায় আমি একাই কোনওক্রমে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। একমাত্র চিকিৎসক হওয়ায় বহির্বিভাগে রোগী দেখতে দেখতে হঠাৎ জরুরি বিভাগে আসা রোগী দেখতে ছুটে আসতে হচ্ছে। আবার ভর্তি থাকা রোগীদের একরাউন্ড দেখে আসতে দেরি হলে বহির্বিভাগে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীরা চিৎকার শুরু করে দেন। তবে জয়দেববাবু যোগ দিলেও চিকিৎসক সঙ্কট কাটবে না। কবে নাগাদ আরও চিকিৎসক পাব তাও জানি না।’’ বান্দোয়ানের বিডিও মধুসূদন মণ্ডল বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই অবস্থার কথা জেলায় জানিয়েছি। কোনও সুরাহা হয়নি।’’ স্থানীয় তৃণমূল নেতা রঘুনাথ মাঝি, জগদীশ মাহাতো বলেন, ‘‘জেলা নেতাদের জানিয়েছি অবিলম্বে বান্দোয়ান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক না পাঠাতে পারলে যে কোনওদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র অচল হয়ে যেতে পারে।’’ জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষের আশ্বাস, ‘‘বান্দোয়ানের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক প্রশিক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছেন। শীঘ্রই তিনি ফিরে আসবেন।’’ নতুন চিকিৎসক মিলবে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় চিকিতৎসকের ঘাটতি রয়েছে। যেখান থেকে ডাক্তার তুলব সেখানেই সমস্যা হবে। তবু সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’’
বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে চিরুডি, গুরুড় ও লতাপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। একমাত্র চিরুডি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি শয্যা রয়েছে। সে অন্তর্বিভাগ চালু রয়েছে। সেখানেও দুই চিকিৎসকের একজন প্রশিক্ষণের জন্য দুমাস আগে চলে গেছেন। বাকি দু’টিতে কেবলমাত্র বহির্বিভাগ চলছে। ফলে জঙ্গলমহলের এই প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসা পরিষেবা তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘জেলায় ৮৭ জন চিকিৎসক যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৩৬ জন যোগ দিয়েছিলেন। তার মধ্যেও কয়েকজন চলে যাওয়ায় মাত্র ২৬ জনকে পেয়েছি। তবু সঙ্কট মেটানোর চেষ্টা করছি।’’