অ্যামেজিং! হোয়াট উই ক্যান ডু নাও উইথ দ্য ইন্টারনেট!
সুনীতা হাজরাকে বাঁচিয়েছেন যে ব্রিটিশ অভিযাত্রী, তাঁর স্ত্রীর এই উপলব্ধিই আসলে চুম্বকে এই দুনিয়ার মনের কথা।
সেই দুনিয়া, যেখানে এভারেস্টের খবর বাংলা কাগজের হাত ধরেও পৌঁছে যেতে পারে বিলেতের ব্রিটিশ পরিবারে। ইন্টারনেটে সার্চ করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল আনন্দবাজারের পাতা। সেখান থেকেই লিন্ডসে খুঁজে পেয়েছেন সুনীতা হাজরার নাম আর ছবি। যাঁর কথা তিনি শুনেছিলেন স্বামী লেসলির মুখে।
ইন্টারনেট মানে সেই দুনিয়া যেখানে ঝাড়গ্রাম উঠে আসে ইনস্টাগ্রামে, আরামবাগ মিশে যায় লুক্সেমবার্গে। কিছুদিন আগে বাংলা ছবি ‘হনুমান ডট কম’-এ দেখা গিয়েছিল, চ্যাট বান্ধবীর খুনের রহস্য ভেদ করতে প্রসেনজিৎ বাংলার গ্রাম থেকে পাড়ি জমাচ্ছেন সুদূর আইসল্যান্ডে। সেখানে তাও চ্যাট-এ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই কথাবার্তা হতো। কিন্তু আনন্দবাজারের সূত্র ধরে যে ভাবে লিন্ডসে আর সুনীতা একাকার হলেন, তাতে ভাষার দেওয়ালও গুঁড়িয়ে গেল।
লিন্ডসে বাংলা জানেন না। তিনি আনন্দবাজারের পাঠক নন। কিন্তু গ্লোবাল আর লোকাল মিলেমিশে যাওয়া বিশ্বের মুক্ত আঙিনাতেই এখন ডানা মেলছে বাংলা ভাষা। সেই ডানায় ভর করেই তো সুনীতার খবর ঠিক খুঁজে নিয়েছেন লিন্ডসে। ভাষার এই মানচিত্রের বেড়া টপকানোর শক্তি জুগিয়েছে ইন্টারনেট। আরও খোলসা করে বললে গুগল ট্রান্সলেটর। সবেমাত্র দশ বছর পূর্ণ করল সে। সেই দশম বর্ষপূর্তিতে লিন্ডসের ঘটনা যেন সত্যিই ‘সেরেনডিপিটি’, যে শব্দের খুব কাছাকাছি বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ভাগ্যবান দুর্ঘটনা’।
নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতে পারেন সমস্ত আঞ্চলিক ভাষার সংবাদকর্মীরাও। কারণ, লিন্ডসের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে ভাষা আর কোনও বেড়া নয়। ইন্টারনেট-সাক্ষরতার এই যুগে একটা মত রয়েছে, আন্তর্জাতিক ভাষার দাপটে নাকি ভবিষ্যতে কোণঠাসা হয়ে যেতে পারে দেশীয় ভাষা। অন্য মত অবশ্য বলে, ইন্টারনেটে ভর করেই দেশীয় ভাষাগুলো আরও শক্তিশালী জায়গা করে নিতে পারে বিশ্বের দরবারে। ভাষাবিদ পবিত্র সরকার দ্বিতীয় মতটিকেই সমর্থন করলেন। লিন্ডসের ঘটনা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নিঃসন্দেহে বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক এটা। বিশ্বায়নের একটা মূল কথা থিঙ্ক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল।’’ অর্থাৎ বিশ্বের ভাবনার রসদ নিজের উঠোনে নিয়ে এসে কাজে লাগানো। এখানে সেটাই হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আজ বিপ্লব ঘটিয়েছে ইন্টারনেট। সেই প্রযুক্তির সিঁড়ি বেয়ে দেশীয় ভাষা, মতামত যেভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে যাচ্ছে সেটা তাঁর মতে খুবই গর্বের।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শমিতা সেন এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন প্রবাসে থাকা বাসিন্দাদের ভূমিকার কথা। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা দেশের বাইরে থাকায় দৈনন্দিন জীবনযাপনে নিজের দেশের ভাষা তেমন ব্যবহার করতে পারেন না, ইন্টারনেট তাঁদের নিজেদের ভাষার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ঘটিয়েছে। সেই যোগাযোগে ভর করে দেশীয় সব ভাষাই আরও শক্তিশালী হচ্ছে।’’
যোগাযোগের এই বিপ্লব এবং ভাষার বন্ধনমুক্তি— এই দুইয়েরই সুযোগ নিচ্ছে বাংলা তথা সব দেশজ সংবাদমাধ্যম। কারণ, খবর এখন কেবল টিভি-রেডিওর মতো দৃশ্য ও শ্রুতিমাধ্যম বা ছাপা খবরের কাগজেই সীমাবদ্ধ নয়, তার ডালপালা এখন ছড়িয়ে গিয়েছে ই-দুনিয়া জুড়ে। খবরের ওয়েবসাইট, কাগজের ই-সংস্করণ সবই মিলছে মুঠোফোন থেকে ল্যাপটপ— সর্বত্র। ইংরিজি শব্দের ট্যাগলাইন দিয়ে খুঁজলেও খুলে যাচ্ছে বাংলা তথা সব দেশীয় ভাষায় লেখা খবরের ভাণ্ডার। তাই এখন আর বাংলা খবর বা বাংলা কনটেন্টের অবাঙালি পাঠক তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ তিনি শুধু ইংরিজি শব্দ টাইপ করে বাংলা কনটেন্টই পাবেন না, তা নিমেষে অনুবাদ করে নিতে পারবেন তাঁর পছন্দের ভাষায়।
দেশীয় বা আঞ্চলিক ভাষার আঙিনার আরও বিস্তৃতি ঘটলেও তাদের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া অবশ্য এখনও অনেক বাকি আছে। এমনটাই মনে করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কিন্তু এখনও ইংরেজি। প্রযুক্তিকে বাহন করে আঞ্চলিক ভাষাগুলো তাদের গণ্ডি অনেক বাড়িয়েছে। কিন্তু, ভাষার ক্ষমতায়ন তো কেবল প্রযুক্তি দিয়ে হয় না। তার জন্য আর্থ-সামাজিক বদলটা একান্ত জরুরি।’’
তবে ভুল থেকেই তো ঠিক হয়। এক ধাপ, এক ধাপ পেরিয়েই হয় শৃঙ্গজয়। বাংলা তথা সব দেশীয় ভাষার এখন সেই ধাপ পেরোনোর পর্বই চলছে। সামনে পড়ে থাকা অনন্ত সম্ভাবনাটার কথা মানছেন পবিত্রবাবু ও মৈনাকবাবু দু’জনেই। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অন্তর্জাল-বিপ্লবের জেরে এখন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও অবাধে নিজের মত জানানো যাচ্ছে নিজের ভাষায়। ব্লগ লেখা চলছে পুরোদমে। অন্তর্জালে দেশীয় ভাষার এই ‘অনুপ্রবেশ’ তাই ভাষায় ভবিষ্যতকেই উজ্জ্বল করবে বলে আশা সবার।
দু’দশক আগে মহীনের ঘোড়াগুলি জানিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীটার ছোট হতে হতে বোকাবাক্সতে বন্দি হয়ে যাওয়ার কথা। তাদের আশঙ্কা ছিল, আমরা আরও দূরে দূরে সরে যাব না তো? কুড়িটি বসন্ত পেরিয়ে অবশ্য এখন নব্য বাঙালি বলতেই পারেন, পৃথিবী আরও ছোট হয়ে গেলেও দূরে সরে না গিয়ে আরও কাছে আসা যায়। অন্তর্জালের ফাঁদে পা দিয়ে বলা যায়, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।