শৈশবে হেনস্থার মাসুল কি দিতে হয় আজীবন

প্ল্যাটফর্মে মেট্রোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যেই টিভি-র পর্দায় চোখে পড়তে পারে এক মহিলার এমন আক্ষেপ। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ঘটনা অভিজ্ঞতা বড় বয়সে এসে মনে করার এই কথাগুলো একটি বিজ্ঞাপনের অংশমাত্র। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, এমনটা কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:১২
Share:

ছোটবেলায় নাচের ক্লাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এক আত্মীয়ের হাতে। মা বলেছিলেন, বাড়ির কথা বাইরের কাউকে না বলতে। সেই সঙ্গেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর নাচের ক্লাসে যাওয়া।

Advertisement

প্ল্যাটফর্মে মেট্রোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যেই টিভি-র পর্দায় চোখে পড়তে পারে এক মহিলার এমন আক্ষেপ। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ঘটনা অভিজ্ঞতা বড় বয়সে এসে মনে করার এই কথাগুলো একটি বিজ্ঞাপনের অংশমাত্র। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, এমনটা কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। কম বয়সে ঘটা কোনও যৌন হেনস্থা এ ভাবেই সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় অনেককে। যার প্রভাব পড়ে শুধু সেই মানুষটির মানসিক গঠনেই নয়, তাঁর আচরণ এবং সমস্ত সামাজিক সম্পর্কের উপরে। অনেক ক্ষেত্রে এর জের গিয়ে পড়ে আক্রান্তদের সন্তানের উপরেও।

আরও পড়ুন: নির্যাতনের অভিযোগ আরও এক স্কুলে

Advertisement

ঠিক যেমন ওই বিজ্ঞাপনটি আর একটু এগোলেই দেখা যায়। যৌন হেনস্থার কারণে ছোটবেলায় নাচ শেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে নিজের মেয়েকে নাচ শেখাতে চান ওই মহিলা। আপাত ভাবে খুব সহজ একটা ঘটনা হলেও এই বিজ্ঞাপন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কী ভাবে ছোটবেলায় ঘটা একটি অন্যায় সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকে এক আক্রান্তের।

শুধু বিজ্ঞাপনী ছবি নয়, বাস্তবটাও তেমনই। মনোবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্ব বলছে, ছোটবেলায় কোনও ধরনের যৌন হেনস্থা খুব ক্ষতি করে আক্রান্তের মানসিক গঠনে। চার-পাঁচ, দশ-বারো বছর বয়সে ঘটা কোনও যৌন নিগ্রহে আতঙ্ক তৈরি হলেও বিষয়টি সে বয়সে স্পষ্ট না-ও হতে পারে তার কাছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আঘাত আরও বড় আকার নেয়। মনোরোগের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব জানান, ছেলেবেলায় কোনও নির্যাতনের ঘটনায় নড়ে যায় ভিতটাই। তিনি বলেন, ‘‘এমন আক্রান্তদের মধ্যে অনেক সময়ে উদ্বেগ, মানসিক চাপের মতো সমস্যা দেখা দেয় বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।’’ অসুবিধে দেখা দেয় যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। কেউ কেউ যেমন অতি সাহসী হয়ে ওঠে, কেউ আবার একেবারেই গুটিয়ে যায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে।

এমনটা নিজেই এক পড়ুয়ার ক্ষেত্রে দেখেছেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। বছর কুড়ির সেই তরুণীকে আতঙ্ক থেকে বার করতে হয়েছে ধীরে ধীরে সেই কথাগুলোই বলে ফেলতে সাহায্য করে। ওই তরুণীকে এগিয়ে যেতে জোর দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক থেকে শুরু করে সহপাঠী-বন্ধুরা। অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘সব ঘটনা আটকানো যায় না। কিন্তু এক আক্রান্তকে যাতে সেই দুর্ঘটনার মাসুল আজীবন না গুনতে হয়, সে দিকে নজর দেওয়া দরকার আশপাশের সকলেরই।’’

এ বিষয়ে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে আক্রান্তের পরিবারই। এমনই বলছে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিহেভিয়রাল সায়েন্সের এক সমীক্ষা রিপোর্ট। কারণ মনোবিদদের মতে, পরিবার যে কোনও মানুষের সবচেয়ে বেশি সাহস এবং আশ্রয়ের জায়গা হয়। যে কারণে এক আক্রান্তের মানসিক চাপের জন্য ভুক্তভোগীও সবচেয়ে বেশি হতে হয় তার পরিবারের সদস্যদেরই। সাধারণত দেখা যায়, ছোটবেলায় যৌন হিংসায় আক্রান্তদের অনেকেই বেশ বড় বয়সে গিয়ে বুঝতে পারেন কতটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তাঁর মনে। কেউ কেউ হয়তো তা-ও পারেন না। আর না বুঝেই বহু সমস্যার শিকার হন। যেমন অভিজিৎবাবু জানান, এ ধরনের আক্রান্তদের অনেকেরই বিয়ের সময়ে সমস্যা হয়। প্রথাগত যে আচরণ তার থেকে প্রত্যাশিত, অনেক সময়েই তা দেখা যায় না তাদের মধ্যে। ফলে দাম্পত্য-জীবনে সমস্যা দেখা দেয়। মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, অনেকের মধ্যেই ভয়ঙ্কর মাত্রায় অপর লিঙ্গের মানুষের প্রতি সন্দেহ বাতিক দেখা দেয়। যা মারাত্মক ভাবে ক্ষতি করে পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে।

তবে এমন এক হিংসার ভার আজীবন বয়ে বেড়ানোর থেকে মুক্তির চেষ্টা করাই যায়। বিজ্ঞাপনের সেই মায়ের মতো যেন চুপ করিয়ে না দেওয়া হয় কোনও নির্যাতিতকে। যে বয়সেই সে কথা বলতে চায়, কাছের লোকেরা যেন শোনেন তার কথা। কনসালট্যান্ট সাইকোলজিস্ট সুদর্শনা দাশগুপ্ত যেমন জানান, খুব ছোটরা অনেক সময়ে কথা বলে নিজের যন্ত্রণার কথা বোঝাতে পারে না। কেউ কেউ আবার লজ্জাও পায়। তাদের জন্য অন্য ধরনের থেরাপিও আছে। বিশেষ করে আর্ট থেরাপি খুবই কাজের। ছবি এঁকেই কিছুটা মনের কথা বলতে শেখে তাতে শিশুরা। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘সেই শিশু যে একাই এমন অমানবিকতার শিকার হয়নি, তা তাকে বোঝাতে হবে। অন্যদের উদাহরণ দেওয়া যায় এর জন্য। তাকে বোঝাতে হবে, যা ঘটেছে, তাতে তার দোষ নেই।’’ মনোবিদ থেকে সমাজতাত্ত্বিক, সকলেই জানাচ্ছেন, এ ভাবেই সামান্য হলেও স্বস্তি দেওয়া যাবে তাকে। না হলে থেকে যায় আরও বড় ভয়। যন্ত্রণা চেপে রাখতে রাখতে কোনও নির্যাতিতের মধ্যে দেখা দিতে পারে একই রকম বিকৃতি, জানাচ্ছেন এক মনোবিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন