প্রচারেও আশাপ্রদ সাড়া নেই জন্ম নিয়ন্ত্রণে

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রচারের অন্ত নেই। কিন্তু সেই অনুযায়ী ফল মিলছে কি? পরিসংখ্যানেই উঠছে প্রশ্ন। কারণ, এখনও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বর্তমানে বছরে গড়ে ৮১ হাজার শিশুর জন্ম হয়।

Advertisement

বরুণ দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫৬
Share:

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রচারের অন্ত নেই। কিন্তু সেই অনুযায়ী ফল মিলছে কি? পরিসংখ্যানেই উঠছে প্রশ্ন। কারণ, এখনও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বর্তমানে বছরে গড়ে ৮১ হাজার শিশুর জন্ম হয়।

Advertisement

২০০১ সালে জেলার জনসংখ্যা ছিল ৫১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৪১১। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৫৭। অর্থাত্‌ বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ। প্রশাসন সূত্রে খবর, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, জেলার জনসংখ্যা ছিল ৫৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৫৭। তার মধ্যে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার ১২। অথচ ২০০১ সালে শিশুর সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ ৫২ হাজার ৩৮।

স্বাস্থ্য দফতরের অবশ্য দাবি, গ্রামাঞ্চলে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচারের প্রভাব পড়েছে। সচেতনতা বেড়েছে। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, ‘‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতেই হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নতির লক্ষ্য হল মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। আর উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা একান্ত প্রয়োজন।” তাঁর দাবি, “আগের থেকে সচেতনতা বেড়েছে। এখন অনেক পরিবারই এ বিষয়ে সচেতন হয়েছে।”

Advertisement

তবে দেখা যাচ্ছে, দম্পতি পিছু সন্তানের জন্মহারও খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই খবর, শহরাঞ্চলে ছোট পরিবারের ধারণা অনেকটাই প্রভাব ফেলেছে। দম্পতিদের বেশিরভাগেরই এখন একটি করে সন্তান। খুব বেশি হলে দু’টি। তবে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত কিংবা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ছবিটা এখনও বদলায়নি। এখনও বহু পরিবারে দম্পতিদের তিন- চারটি সন্তান হচ্ছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্রবাবু বলেন, “সর্বত্র সমান সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। মানুষ সচেতন হলেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব।’’ জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “শহরাঞ্চলে আগে যেখানে দম্পতিদের দু’-তিনটি সন্তান হত, এখন সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি সন্তানই হচ্ছে। দম্পতিরা পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনের ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন। গ্রামাঞ্চলের কিছু এলাকায় সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সর্বত্র সমান সচেতনতা গড়ে তোলাটা আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। জেলায় এই কাজটা শুরুও হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজন ও পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা সর্বজনীন সচেতনতায় জোর দিয়েছি।” জেলার এক স্বাস্থ্য-কর্তার দাবি, “কেশপুরের একটি এলাকায় বছর পনেরো আগেও দম্পতিরা গড়ে তিনটি করে সন্তান নিতেন। এখন সেখানে গড়ে দু’টি করে সন্তান নিচ্ছেন। অর্থাত্‌, সচেতনতা বাড়ছে।’’ ওই স্বাস্থ্য কর্তাই মানছেন, “জেলার সর্বত্র শিক্ষার আলো সমান ভাবে পৌঁছয়নি। ফলে, সর্বত্র সমান সচেতনতা গড়ে তুলতে আরও কিছু সময় লাগবে।’’

জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনঘনত্বও। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাসকারী জনসংখ্যার পরিমাণকে জনঘনত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে জেলা জনঘনত্ব ছিল ৫৫৬ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটার। সেখানে ২০১১ সালে জেলার জনঘনত্ব ৬৩১ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটার। জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (১) সৌম্যশঙ্কর ষড়ঙ্গীর বক্তব্য, ‘‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোর জন্য প্রতিটি দম্পতির পরিকল্পনা মাফিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারও চলছে।’’

একইভাবে, জেলার উপ- মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (২) রবীন্দ্রনাথ প্রধানের ব্যাখ্যা, “আমাদের তিনটি পি কমাতে হবে। এক, জনসংখ্যা (পপুলেশন)। জনসংখ্যা কমলে এক দিকে যেমন দূষণ (পলিউশন) কমবে, অন্য দিকে তেমনই দারিদ্র (পভার্টি) কমবে।’’ ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১২১.০২ কোটি। ২০০১-২০১১ এই দশকে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৭৬। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে অচিরেই জনসংখ্যার বিচারে চিনকে ছাড়িয়ে যাবে দেশ। স্বাস্থ্য- কর্তাদের বক্তব্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নানা সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। এই সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে গেলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ দরকার।

পশ্চিম মেদিনীপুরে বছরে কত শিশু জন্মগ্রহণ করে?

২০১২-’১৩ তে জেলায় ৮৪,১৩৭ জন শিশুর জন্ম হয়। ২০১৩-’১৪-তে জন্ম হয় ৮২,০৯৯ জন শিশুর। ২০১৪-’১৫-তে ৭৬,৮৪৯ শিশুর জন্ম হয়। অর্থাত্‌, জেলায় এখন বছরে গড়ে ৮১ হাজার শিশুর জন্ম হয়। জেলার এক স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, ‘‘এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রচারের প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও পড়ছে। আগের থেকে সচেতনতা বেড়েছে।’’ যদিও বাস্তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের হার নিয়ে সংশয় রয়েছে।

জন্ম প্রচারে ঠিক কী বলা হয়? মূলত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ এবং তা জানার ভিত্তিতে নির্বাচন ও গ্রহণ করাতেই উত্‌সাহ দেওয়া হয়। ওই স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, ‘‘ছোট পরিবারের ধারণা ও পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজন ও পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্যই মূলত এই প্রচার চলে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মহিলারা বন্ধ্যাত্বকরণ করতে পারেন। যে মহিলা আর বাচ্চা চান না, তার জন্য এটিই কার্যকরী ও স্থায়ী পদ্ধতি। ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সরকারি হাসপাতালে এই পরিষেবা প্রদান করা হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পুরুষরাও নির্বীজকরণ করতে পারেন। বাচ্চার জন্মকে স্থায়ী ভাবে বন্ধ করার জন্য একটি ছোট অপারেশন। এর জন্য হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না।’’

জেলার অন্য এক স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, এই স্থায়ী পদ্ধতিগুলো সরল, সুবিধাজনক। এর ফলে কারও কার্যক্ষমতাও কমে না। যৌন ক্ষমতাও কমে না। গর্ভাবস্থা এড়ানোর জন্য অনেক মহিলাই গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান। কিন্তু, এর প্রাপ্তি সম্পর্কে তারা সচেতন নন। এ ভাবেই অপরিকল্পিত গর্ভাবস্থার জন্য গর্ভপাত করাতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে গর্ভাবস্থা ঠেকানো দরকার। যা তাকে অনিরাপদ গর্ভপাত, প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা এবং দীর্ঘ সময় রোগ ভোগের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে।

এ জন্য অবশ্য অস্থায়ী পদ্ধতিও রয়েছে। যেমন পুরুষদের ক্ষেত্রে নিরোধ ব্যবহার করা। মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়া। ওই স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, ‘‘অবাঞ্চিত গর্ভধারণকে প্রতিরোধ করার জন্য নিরোধের সঠিক আর নিয়মিত ব্যবহার প্রয়োজন। দম্পতি নিরোধের ব্যবহার যখন খুশি বন্ধ করে দ্বিতীয় বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। যে সব মহিলা প্রথম গর্ভাবস্থা দেরিতে চান, কিংবা দু’টি সন্তানের মধ্যে ব্যবধান চান, তাদের জন্য গর্ভনিরোধক বড়ি একটি উপযোগী, নিরাপদ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য গর্ভনিরোধক পদ্ধতি।’’ জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “জনসংখ্যার চাপে বিভিন্ন এলাকা অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ছে। জনঘনত্ব এ ভাবে বাড়তে থাকলে আগামী দিনে নানা সমস্যা দেখা দেবে। এ নিয়ে সকলকেই সচেতন হতে হবে।” স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলেও দম্পতিদের অবহিত করা হচ্ছে। এই কাজের সঙ্গে আশা কর্মী-সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে যুক্ত করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন