Coronavirus

করোনায় ঘরবন্দি অবসাদের মোকাবিলা

ঘরে বসে দমবন্ধ হয়ে আসছে মানুষের, পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে নানা মানসিক সমস্যা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৪৭
Share:

মানবসভ্যতা এক গভীর সঙ্কটের মুখে। এখনও পর্যন্ত বিশ্বে নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বারো লক্ষের বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর প্রতিকারে গোটা বিশ্ব এখন লকডাউনে সামিল। ঘরে বসে দমবন্ধ হয়ে আসছে মানুষের, পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে নানা মানসিক সমস্যা। এর সমাধান নিয়ে কথা বললেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ সুমন্তকুমার সাহা

Advertisement

Advertisement

প্রশ্ন: মূলত কী কী চিন্তা মানুষকে শঙ্কিত করে তুলছে?

যে বিষয়গুলি প্রায় প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে সেগুলি হল, নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, যদি কোয়রান্টিনে যেতে হয় তবে পরিবারের সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কষ্ট, যদি বিপুল সংখ্যক মানুষের এই অসুখ হয় তবে সীমিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে বেড না পাওয়ার আশঙ্কা, সীমিত স্বাস্থ্যকর্মী থাকায় যথার্থ স্বাস্থ্য পরিষেবা না পাওয়ার ভয়, দেশের জনসংখ্যার বিচারে যৎসামান্য ভেন্টিলেটার থাকায় প্রয়োজনে ভেন্টিলেটার না-পাওয়ার উৎকণ্ঠা, এই অসুখের অন্যতম প্রধান লক্ষণ তীব্র শ্বাসকষ্ট সেটা ভেবে ভয় পাওয়া, এমনকি যদি মৃত্যু হয় তবে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে শেষকৃত্য না হবার অলীক আশঙ্কা। এ ছাড়াও রয়েছে, এই লকডাউন কত দিন চলবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কত দিন পাওয়া যাবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা, কত দিনে এই অসুখ থেকে পৃথিবী মুক্ত হবে তার আশঙ্কা এবং রোগ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এবং সামাজিক অস্থিরতা।

প্রশ্ন: এই সময় কী ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে?

পুরনো মানসিক রোগী (যেমন ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার, প্যানিক ডিজ়অর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার) যারা ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সুস্থ ছিলেন, তাদের মধ্যে এই আতঙ্কের আবহে পুরনো সমস্যাগুলি আবার ফিরে আসতে পারে। আবার বহু মানুষের মধ্যে নানা রকম মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যাদের পূর্বে কোনও মানসিক রোগ ছিল না। সেই অসুখগুলি এবং তাদের লক্ষ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্যানিক অ্যাটাক: এই অসুখে হঠাৎ করেই রোগীর বুক ধড়ফড় করে এবং হৃদস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা থরথর করে কাঁপে, সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়, বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, শরীর অস্থির করে, সারা শরীরে ভীষণ গরম অনুভূত হয় এবং সর্বোপরি মনে হয় যেন এক্ষুনি প্রাণ বেরিয়ে গিয়ে মৃত্যু হয়ে যাবে। এই রকম সমষ্টিগত তীব্র কষ্ট ১০ মিনিট পর্যন্ত হতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে কমে যায়। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার এইরকম অ্যাটাক হতে পারে।

অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজ়সঅর্ডার: এই অসুখে নানা রকম ব্যবহারিক অসংলগ্নতা দেখা দিতে পারে। যেমন পারিপার্শ্বিক সমস্যার প্রতি (এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস এর সমস্যা) কম প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়া, পরিবেশের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়া, সব কিছু ভুলে যাওয়া। এক কথায় বললে, এই মহামারি থেকে হঠাৎ করে সম্পূর্ণরূপে নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়া।

কনভার্সন ডিজ়অর্ডার: এ ক্ষেত্রে রোগী ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অজ্ঞান অবস্থায় রোগী চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। এই রকম অবস্থা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সেই সময়ে রোগীকে ডাকাডাকি করলেও সাড়া পাওয়া যায় না। তবে এই মূর্ছিত অবস্থায়, রোগী সব কিছু শুনতে পান কিন্তু কথা বলতে পারেন না, চোখ খুলতে পারেন না।

অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজ়অর্ডার: এ ক্ষেত্রে রোগীর মনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। কারও মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেউ মাত্রাতিরিক্ত টেনশন করেন। আবার কারোও আচরণগত সমস্যা (কান্নাকাটি করা, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা) দেখা দেয়।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিস: এ ক্ষেত্রে রোগীর যদি করোনা সংক্রমণের সামান্যতম লক্ষণ দেখা দেয় ( গলা ব্যথা, সিজনাল জ্বর সর্দি), তবে ভীষণ উতলা হয়ে পড়ে এবং মনে করেন যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে একই চিন্তা তার ঘুরপাক খেতে থাকে এবং নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য (এ ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা) উতলা হয়ে ওঠেন।

স্লিপ ডিজ়অর্ডার: এই সময় নানা রকম ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন, ঘুম আসতে দেরি হওয়া, বিছানায় শোয়ার পর নানা দুশ্চিন্তা মাথায় আসা, বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া, ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখা, ঘুমের মধ্যে কথা বলা ইত্যাদি।

প্রশ্ন: কী ভাবে এই অসুখের চিকিৎসা করা সম্ভব?

নোভেল করোনাভাইরাসের প্যানডেমিক এর ফলে উপরিউক্ত যে সব মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তার বেশির ভাগই তাৎক্ষণিক, অর্থাৎ এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দূর হয়ে যাওয়ার পর, বেশিরভাগ মানুষেরই সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে চলে যাবে। এই মুহূর্তে মানুষকে নানারকম মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, খুব দ্রুত অ্যাংজ়াইটি কমানোর যে ওষুধ রয়েছে (অ্যাংজিওলাইটিক) সেগুলি স্বল্পমেয়াদী (তিন থেকে ছয় সপ্তাহ) সময়ের জন্য প্রেসক্রাইব করা হচ্ছে। এর ফলে মানুষ সাময়িক স্বস্তি পাচ্ছেন। এ ছাড়াও ফোনের মাধ্যমে যতটুকু কাউন্সেলিং করা সম্ভব (ব্রিফ সাইকোডায়নামিক সাইকোথেরাপি), তা করে রোগীকে সাহায্য করা হচ্ছে। খুব অল্প মানুষ, যাদের সমস্যাগুলি থেকে যাবে, তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করতে হতে পারে।

প্রশ্ন: এই আবহে রোগীরা কী ভাবে ডাক্তারsর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন?

রোগীকে দেখে চিকিৎসা শ্রেয়। তবে এই ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে রোগী ও তার বাড়ির লোক চিকিৎসার জন্য ডাক্তারবাবুর কাছে এলে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে এবং লকডাউন সফল হবে না। সে জন্য এই সময় টেলি কনসাল্টেশন (টেলিফোন ,ভিডিও কলিং, হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে) প্রয়োজন।

যে সমস্ত পুরনো রোগীরা ওষুধ খেয়ে ভাল আছেন, তারা ডাক্তার বাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ওষুধ চালিয়ে যেতে পারেন। যদি পুরনো রোগীর নতুন করে কোনও সমস্যা হয় অথবা কোন সুস্থ মানুষের (যার পূর্বে কোন মানসিক রোগের ইতিহাস নেই) মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তবে টেলিফোন অথবা ভিডিও কলিং এর মাধ্যমে ডাক্তারবাবুকে জানাতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তারবাবু ফোনের মাধ্যমে (হোয়াটসঅ্যাপে প্রেসক্রিপশন করে) সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। যদি একান্তই সমস্যার সমাধান না হয়, তবে কোন প্রটেক্টেড জায়গায় (সরকারি হাসপাতাল অথবা প্রাইভেট নার্সিং হোম) ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হবে।

প্রশ্ন: একঘেয়েমি কাটাতে উপায় কি?

লকডাউন এর ফলে সবাই গৃহবন্দি। সারাদিন ঘরে বসে থেকে সকলের দমবন্ধ করা অবস্থা। তার মধ্যেও নানা ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মধ্য দিয়ে, দিন অতিবাহিত করা যেতে পারে। বাড়ির দৈনন্দিন যেসব কাজকর্ম, যেমন ধরুন রান্না করা, ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা রয়েছে (যেগুলি বেশিরভাগ বাড়িতেই পরিচারিকারা করে থাকেন। কিন্তু লকডাউন এর কারণে তারা এখন আসতে পারছেন না) সেগুলি পরিবারের সকল সদস্য মিলেমিশে যদি করা হয়, তাহলে কারও কষ্ট হবে না আবার একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে পারিবারিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে। প্রতিদিন শরীরচর্চা করা একটি অন্যতম প্রধান সুঅভ্যাস। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সময় না থাকার অজুহাতে, বেশির ভাগ মানুষই শরীরচর্চা করেন না। এখন অফুরন্ত সময়ে, প্রতিদিন শরীর চর্চা করুন। এটা শরীরচর্চার সুঅভ্যাস শুরু করার যেমন সুবর্ণ সুযোগ ঠিক তেমনই শরীর চর্চার মধ্য দিয়ে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা আপনাকে নোভেল করেনাভাইরাসের হাত থেকেও রক্ষা করবে। ফুরন্ত অবসর সময়ের কারণে, স্মার্ট ফোন (সোশ্যাল মিডিয়া এবং মোবাইল গেম) আপনাকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু খুব সাবধান। এই সময় ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিজ়অর্ডার-এ আপনি আসক্ত হয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ার নানা রকম গুজবে আপনি আতঙ্কিত হতে পারেন। সে জন্য মোবাইলের সীমিত ব্যবহারই এইসময় শ্রেয়। তবে পরিবেশের সাথে আপটুডেট থাকার জন্য, সংবাদ পত্র পড়ুন অথবা টিভিতে সংবাদ দেখতে পারেন। এই সময় নিজের পছন্দমত বই (বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই অথবা কবিতার বই) পড়ে ফেলতে পারেন, পুরনো দিনের গান শুনতে পারেন, পুরনো সিনেমা দেখতে পারেন। এই অবসরে নিজের শিল্পীসত্তাকে (যা দৈনন্দিন কাজের চাপে নষ্ট হয়ে গেছিল) একটু অক্সিজেন দিতে পারেন। যেমন গান করা, আবৃত্তি করা, ছবি আঁকা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র (গিটার, তবলা) বাজানো, কবিতা অথবা গল্প লেখা অথবা যে কোনো সৃজনশীল কাজ করা যেতে পারে। এতে নিজের মন ভাল থাকবে এবং করোনা আতঙ্ক থেকে খানিকটা রেহাই পাওয়া যাবে। বাড়িতে যদি কারো কোন পোষ্য প্রাণী থাকে (কুকুর, বেড়াল, রঙিন মাছ), তবে এই সময় তাদের পরিচর্যা করা যেতে পারে। আবার কারজও যদি ইনহাউস গার্ডেনিং এর নেশা থাকে, তাহলে কিছুটা সময় গাছেদের পরিচর্যায় অতিবাহিত হবে। সবশেষে বলি, পরিবারের সবাই মিলে বসে গল্পের মাধ্যমে সময় কাটান। দেখবেন মন অনেক হালকা হবে।

সাক্ষাৎকার: সামসুদ্দিন বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন