মোটা হলেই কি ডায়াবেটিস? উপায় বাতলাচ্ছে কলকাতা

শরীর দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। মেদ জমে মধ্যপ্রদেশের বহর চোখে পড়ার মতো! মাপুনি যন্ত্রে দাঁড়ালে ওজন-কাঁটা দৌড়চ্ছে হুড়হুড়িয়ে! অর্থাৎ, মোটা হচ্ছেন। শারীরিক নানা অসুবিধে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে কালান্তক ডায়াবেটিসের খপ্পরে পড়ার ভয়ও কি আছে?

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:০০
Share:

শরীর দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। মেদ জমে মধ্যপ্রদেশের বহর চোখে পড়ার মতো! মাপুনি যন্ত্রে দাঁড়ালে ওজন-কাঁটা দৌড়চ্ছে হুড়হুড়িয়ে!

Advertisement

অর্থাৎ, মোটা হচ্ছেন। শারীরিক নানা অসুবিধে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে কালান্তক ডায়াবেটিসের খপ্পরে পড়ার ভয়ও কি আছে?

আছে কিনা, এ বার তা আগাম জানা যাবে বলে দাবি করল কলকাতার এক গবেষকদল। এতে বিপত্তি ঠেকানোর পথ সন্ধানের আশাও মজুত। বস্তুত মোটা মানুষদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের দাঁত-নখ যেন আরও বেশি করে বেরোয়। কারণ, ওজনবৃদ্ধিজনিত ডায়াবেটিসের গলায় ইনসুলিনও রাশ পরাতে পারে না। ফলে তা কার্যত বেগালাম হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় আনুষঙ্গিক নানা শারীরবৃত্তীয় সমস্যার। যা অকালমৃত্যুও ডাকতে পারে।

Advertisement

অথচ খাদ্যাভ্যাস ও জীবনশৈলীর পরিবর্তনের জেরে বাড়তি ওজনের (ওবেসিটি) সমস্যা দুনিয়া জুড়েই আগ্রাসী। এ ব্যাপারে হু বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। পাশাপাশি ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ ডায়াবেটিসের ফাঁদে পড়তে চলেছেন কিনা, তা আগাম জানার পদ্ধতি খুঁজতে বিশ্ব জুড়ে চলছে গবেষণা। কলকাতাও তাতে শরিক। এবং এ শহরেরই এক দল গবেষকের দাবি, অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। ওঁদের বক্তব্য: মোটা হতে থাকা কিছু মানুষের রক্তে এমন দু’টি উপাদানের খোঁজ মিলেছে, যা কিনা ডায়াবেটিসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ওই দু’টিই ইনসুলিনকে অকেজো করে দেয়। আর রক্তে এই দু’টিরই উপস্থিতি জরিপ করে আন্দাজ মিলতে পারে, মোটাদের ডায়াবেটিস হতে চলেছে কিনা।

যাদবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি (আইআইসিবি), এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এ়ডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর) এবং সল্টলেকের আইএলএস হাসপাতালের যৌথ গবেষণাপত্রটি ‘ডায়াবেটিস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদলে রয়েছেন আইআইসিবি’র দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় ও অমৃতরাজ ঘোষ, এসএসকেএমের সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও পরাশর ঘোষ এবং আইএলএসের ওম তাঁতিয়া। রক্তের উল্লিখিত উপাদান দু’টি (কেমেরিন ও টাইপ-ওয়ান ইন্টারফেরন) ঠিক কী ভাবে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা ছাঁটাই করে, সে সম্পর্কেও তাঁদের নিবন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে।

ফলে যুঝবার মতো উপযুক্ত ওষুধ তৈরির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। মেদবৃদ্ধির সঙ্গে ‘সুগারের’ বিপদ ঠিক কী ভাবে সম্পর্কিত? দীপ্যমানবাবুর ব্যাখ্যা: ওজন বাড়তে থাকলে চর্বির (ফ্যাট) আস্তরণে ঢুকে পড়ে বিশেষ ধরনের বেশ কিছু শ্বেত রক্তকণিকা (ডব্লিউবিসি)। ছোট মাপের অথচ দীর্ঘস্থায়ী শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া (ইমিউন রেসপন্স) শুরু হয়ে যায়। ‘‘এরই জেরে নির্গত জৈব রাসায়নিকের প্রভাবে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পায়।’’— বলছেন দীপ্যমানবাবু।

প্রক্রিয়াটি আরও বিশদে বর্ণনা করেছেন ওই বিজ্ঞানী। তাঁর কথায়, ‘‘ম্যাক্রোফাজ নামে সংশ্লিষ্ট ডব্লিউবিসি ফ্যাটের আস্তরণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলে। আয়তনবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে ‘কেমেরিন’ নামে জৈব রাসায়নিক বেরোয়। যার টানে হাজির হয় অন্য এক ধরনের ডব্লিউবিসি— প্লাজমাসাইটয়েড ডেনড্রাইটিক সেল (পিডিসি)।’’ ইনসুলিনকে ঠুঁটো করার পর্ব আর এক ধাপ এগোয়। কী রকম?

দীপ্যমানবাবু বলেন, ‘‘ফ্যাটের আস্তরণে ঢুকে পড়া পিডিসি থেকে বার হয় আর এক জৈব রাসায়নিক— টাইপ-ওয়ান ইন্টারফেরন। তার প্রভাবে চর্বির স্তরে মজুত ম্যাক্রোফাজ সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেগুলো আবার এমন কিছু জৈব রাসায়নিক বানায়, যেগুলোর সামনে ইনসুলিনের কিছু করার থাকে না।’’ সতীনাথবাবু বলেন, ‘‘ওবেসিটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কারা ডায়াবেটিসের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন, সে আঁচ মিলতে পারে রক্তে কেমেরিন ও টাইপ-ওয়ান ইন্টারফেরনের মাত্রা দেখে। তখন আগাম সতর্কতা নেওয়া সম্ভব।’’

যদিও এর জন্য আরও গবেষণা জরুরি বলে জানিয়েছেন ওঁরা। ওঁদের দেওয়া সূত্র ধরে ওষুধ তৈরির লক্ষ্যে গবেষণা অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছে আইআইসিবি’তে। শহরের চিকিৎসক মহলও বিলক্ষণ আশাবাদী। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘রক্ত পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ার অনেক আগেই শরীরে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়। তাই আগাম জানতে পারলে মস্ত লাভ। আগে আঁচ পেলে ডায়াবেটিসজনিত দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন জটিলতা অনেকটা এড়ানো যাবে।’’ এন্ডোক্রিনোলজিস্ট আশিস বসুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘পেটে জমা মেদ বেশি ক্ষতিকর। ওই ভিসেরাল ফ্যাটে থাকা বিশেষ কিছু রাসায়নিক ইনসুলিনকে ঠুঁটো করে দেয়। রাসায়নিকটিকে চিহ্নিত করা গেলে তাকে ঠেকানোর উপায়ও বার হবে।’’

এ হেন প্রেক্ষাপটে গবেষণাটিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করছেন বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের অনেকে। আইআইসিবি-র অধিকর্তা সমিত চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘ওঁদের গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে আমরা নতুন ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা করছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন