খিঁচুনি জ্বরের সিঁদুরে মেঘ দক্ষিণেও

বর্ধমানের পরে এ বার বাঁকুড়া। দক্ষিণবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ দুই জেলায় গত দু’দিনে এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গের দুই রোগী পাওয়া যাওয়ায় বিশেষজ্ঞেরা রাজ্য সরকারকে সতর্ক করে দিলেন। বিশেষত রবিবার বাঁকুড়ায় তীব্র এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গে (অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম, সংক্ষেপে এইএস) একটি শিশুর মৃত্যুর পরে মানুষকে আরও সচেতন করার উপরে জোর দিচ্ছেন জীবাণু-বিজ্ঞানী ও পতঙ্গবিদেরা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৩৯
Share:

এনসেফ্যালাইটিসে সন্তানকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা ও দিদা। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে শুভ্র মিত্রের তোলা ছবি।

বর্ধমানের পরে এ বার বাঁকুড়া। দক্ষিণবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ দুই জেলায় গত দু’দিনে এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গের দুই রোগী পাওয়া যাওয়ায় বিশেষজ্ঞেরা রাজ্য সরকারকে সতর্ক করে দিলেন। বিশেষত রবিবার বাঁকুড়ায় তীব্র এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গে (অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম, সংক্ষেপে এইএস) একটি শিশুর মৃত্যুর পরে মানুষকে আরও সচেতন করার উপরে জোর দিচ্ছেন জীবাণু-বিজ্ঞানী ও পতঙ্গবিদেরা। স্বাস্থ্যভবন বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তার কোনও আঁচ অবশ্য এখনও মেলেনি।

Advertisement

বাঁকুড়ার বাচ্চাটিকে বাদ দিলে শনিবার রাত থেকে রবিবার বিকেলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে জ্বরে আক্রান্ত মোট আট জনের মৃত্যু হয়েছে। আট জনই উত্তরবঙ্গের। এঁদের দু’জনের জাপানি এনসেফ্যালাইটিস হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলি জানিয়েছে। বাকি ছ’জনের মধ্যে পাঁচ জনের এইএস ছিল। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা না-হওয়ায় ছ’জনেরই মৃত্যুর কারণ অজানা থেকে গিয়েছে।

বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরের গোপালগঞ্জের বাসিন্দা অয়ন কুচলান নামে তিন বছরের শিশুটি মারা যায় শনিবার রাতে, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গৌতমনারায়ণ সরকার রবিবার বলেন, “এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গে বাচ্চাটি মারা গিয়েছে। সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ) পরীক্ষায় প্রমাণ, ওর মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়েছিল।”

Advertisement

পাশাপাশি শনিবার বর্ধমানের কাঁকসার চোদ্দো বছরের এক কিশোরকে জ্বর ও খিঁচুনি-সহ দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতাল ঘুরিয়ে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। এ দিন বাড়ির লোক তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছেন। দুর্গাপুর হাসপাতাল সূত্রে বলা হয়, কিশোরটির রক্ত এবং সিএসএফের নমুনা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও কলকাতায় পাঠানো হয়েছে। বর্ধমান মেডিক্যাল-কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে চায়নি।

বিগত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। এ বার সেই তল্লাটেই ফের এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ মিলতে থাকায় জীবাণু-বিজ্ঞানীদের একাংশ সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন। এবং এমন যখন অবস্থা, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে এ হেন ‘লুকোছাপা’র প্রয়াস দেখেও তাঁরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। ওঁরা বলছেন, বর্ধমান আর বাঁকুড়া এমনিতেই জাপানি এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ এলাকা। বিশেষত উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি মাথায় রেখে দক্ষিণবঙ্গের এই দুই জেলায় নজরদারি বাড়ানো জরুরি।

অথচ স্বাস্থ্য প্রশাসনের তরফে সেই উদ্যোগ কতটা জারি রয়েছে, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। বস্তুত জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে শনিবার রাতে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে দু’জনের মৃত্যুর খবর কলকাতায় পৌঁছলেও বাকি মৃত্যুগুলি সম্পর্কে বিশেষ তথ্য এ দিন রাত পর্যন্ত স্বাস্থ্যভবন হাতে পায়নি। উপরন্তু অভিযোগ উঠেছে, রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে জ্বর ও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগী আসার হিড়িক দেখে ডাক্তারদের উপরে প্রশাসন কিছু বিধিনিষেধ চাপিয়েছে। এমনকী, প্রেসক্রিপশনে এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গের কথা যাতে না লেখা হয়, কলকাতার সরকারি ডাক্তারদের সেই নির্দেশও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

এ ভাবে রোগ চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টারও সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। যা শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর প্রতিক্রিয়া, “আমি জানি না, কে, কাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে আমার কাছে সমস্ত তথ্য আসছে। তাই আমার কাছে জানতে চাইলে নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে।” কী তথ্য দিচ্ছেন উনি?

অধিকর্তা জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বালুরঘাট ও জলপাইগুড়িতে। কলকাতায় গত দু’দিনে নতুন এইএস-রোগী ভর্তি হয়নি বলেও তাঁর দাবি। বিশ্বরঞ্জনবাবুর হিসেবে, গত ১ জানুয়ারি থেকে এ দিন পর্যন্ত জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে পশ্চিমবঙ্গে ৩২ জন মারা গিয়েছেন, যাঁদের ৩ জন জীবাণু এনেছিলেন ভিন রাজ্য থেকে। এইএস নিয়ে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কর্তারা যা-ই বলুন, রোগ-পরিস্থিতি নিয়ে সচেতনতা প্রচারে কোথাও কোথাও যে যথেষ্ট ঘাটতি থেকে গিয়েছে, এ দিন তা দেখেছে জলপাইগুড়ি। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মৃত শচীমোহন সরকারের অন্ত্যেষ্টি করতে পরিজনকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এনসেফ্যালাইটিস ছোঁয়াচে না-হওয়া সত্ত্বেও সংক্রমণের ভয়ে তাঁর দেহ গ্রামে নিয়ে যেতে দেননি গ্রামবাসীদেরই একাংশ। পরে তাঁরা বাধ্য হয়ে সদর ব্লকের কচুয়া বোয়ালমারির ওই বৃদ্ধের দেহ দাহ করেন জলপাইগুড়ি মাসকলাইবাড়ি শ্মশানে।

উল্টো ছবিও অবশ্য আছে। এ দিন বিষ্ণুপুরে অয়নের বাড়িতে গিয়ে স্থানীয় মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েন রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। জনতার প্রশ্ন ছিল, জনবসতির আশপাশ থেকে শুয়োর কেন সরানো হচ্ছে না? নিকাশি নালাই বা নিয়মিত সাফসুতরো হচ্ছে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন