চার হাসপাতাল

চুক্তিই সার, শিকেয় পিপিপি-র মেডিক্যাল

সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি মডেলে) মেডিক্যাল কলেজ গড়তে গিয়ে ফাঁপরে পড়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। চুক্তির সাত মাস পরেও কোথাও কাজ শুরু না-হওয়ায় বেসরকারি অংশীদারদের ‘আগ্রহ’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের অন্দরে। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি দায়ী করছে সরকারি ‘দীর্ঘসূত্রতা’কে। আবার প্রশাসন ও বিপণন-বিশেষজ্ঞদের অনেকের পর্যবেক্ষণ, লাভের কড়িতে টান পড়বে আঁচ করেই বেসরকারি সংস্থারা এখন পিছিয়ে আসছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৩
Share:

সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি মডেলে) মেডিক্যাল কলেজ গড়তে গিয়ে ফাঁপরে পড়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। চুক্তির সাত মাস পরেও কোথাও কাজ শুরু না-হওয়ায় বেসরকারি অংশীদারদের ‘আগ্রহ’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের অন্দরে। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি দায়ী করছে সরকারি ‘দীর্ঘসূত্রতা’কে। আবার প্রশাসন ও বিপণন-বিশেষজ্ঞদের অনেকের পর্যবেক্ষণ, লাভের কড়িতে টান পড়বে আঁচ করেই বেসরকারি সংস্থারা এখন পিছিয়ে আসছে। যার প্রেক্ষাপটে আঙুল উঠছে পরিকল্পনার বাস্তবতার দিকেই।

Advertisement

সব মিলিয়ে পুরো উদ্যোগ ঘিরে দানা বেঁধেছে ঘোর অনিশ্চয়তা। দু’টি বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে কার্শিয়াং, কোচবিহার, নদিয়ার ধুবুলিয়া, ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে পিপিপি মডেলে চারটি মেডিক্যাল কলেজ চালুর পরিকল্পনা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। স্বাস্থ্য ভবনের খবর: সংস্থাগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ৫৪%-৭২% আসনে ভর্তি হবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ তালিকা থেকে। বাকি আসনে পড়ুয়া নেওয়া হবে ‘ম্যানেজমেন্ট কোটা’য়, ক্যাপিটেশন ফি-র বিনিময়ে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংস্থা দু’টির এই মর্মে চুক্তিও হয়ে যায়। ওই পর্যন্তই। এখনও কোথাও একটা ইটও গাঁথা হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরের অভিযোগ: সংস্থা দু’টি এ ব্যাপারে কোনও যোগাযোগ রাখছে না। একাধিক ক্ষেত্রে দফতর ‘অফার লেটার’ পাঠিয়েও উত্তর পায়নি।

Advertisement

এমতাবস্থায় পিপিপি-তে মেডিক্যাল কলেজ চালাতে সংস্থাগুলো আদৌ উৎসাহী কি না, সে সংশয় প্রকট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের মনে। এমনকী, চুক্তি ভেঙে নতুন সংস্থা বাছাইয়ের চিন্তা-ভাবনাও চলছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমাদের তরফে কোনও অসুবিধা নেই। মনে হচ্ছে, ওদেরই সমস্যা। চুক্তির পর থেকে তারা বেপাত্তা। বারবার তাগাদা দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে অফার লেটার পাঠিয়েও জবাব মেলেনি।’’

এমতাবস্থায় কী করণীয়?

সুশান্তবাবু বলছেন, ‘‘প্রকল্প হাতে নিয়ে অনন্তকাল তো বসে থাকা যাবে না! তেমন হলে ওদের বাদ দিয়ে নতুন সংস্থা বাছা হবে।’’

এ দিকে পুরো ঘটনাক্রমের মধ্যে লাভ-ক্ষতির চিরন্তন ব্যবসায়িক অঙ্কেরই ছায়া দেখছেন সরকার ও বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ। তাঁদের মতে, ক্যাপিটেশন ফি-র আওতাধীন আসনের সংখ্যা কম হওয়ায় সংস্থাগুলির খুব বেশি উপার্জনের সুযোগ থাকছে না। স্বাস্থ্য ভবনের পিপিপি সেলের এক কর্তা বলেন, ‘‘একটা মেডিক্যাল কলেজ মানে বিশাল খরচের ধাক্কা। জয়েন্ট-উত্তীর্ণদের জন্য অত্যন্ত বেশি আসন ছেড়ে দিয়ে সংস্থাগুলো এখন বুঝতে পারছে, যতটা লাভ হবে বলে তারা ধরেছিল, ততটা হচ্ছে না।’’

তাই তারা চাড় দেখাচ্ছে না বলে কর্তাটির অভিমত। ‘‘মনে রাখতে হবে, আশানুরূপ লাভের পথ না-দেখলে কোনও বেসরকারি সংস্থাই এগিয়ে আসবে না। বর্তমান অংশীদারদের সরকার হয়তো বাতিল করল। কিন্তু পরে যারা আসবে, তাদেরও তো একই সমস্যা হতে পারে! এর সমাধান কী?’’— প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বিপণন-বিশেষজ্ঞ শৌভিক মিশ্রের মতে, হাসপাতালের মতো বিষয়টিকে পুরোপুরি লাভ-লোকসানের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা উচিত নয়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বেসরকারি কলেজে মুনাফার তাগিদে সিংহভাগ আসনে ক্যাপিটেশন ফি নিয়ে ভর্তি করা যায়। কিন্তু পিপিপি’তে পরিমিতিবোধ চাই।’’ তবে সেটা করতে গিয়ে আবার মাত্রাতিরিক্ত আসন জয়েন্টের পড়ুয়াদের জন্য ছেড়ে রাখতে হলে যে সমস্যা দেখা দেবে, তা-ও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ‘‘সে ক্ষেত্রে আয়ের বহর কমবে। তাই অংশীদার হতে এগিয়ে আসবে না কেউ। সরকারকেও এটা বুঝতে হবে।’’— বলছেন শৌভিকবাবু।

অর্থাৎ দু’পক্ষেরই স্বার্থরক্ষা হয়, এমন একটি বাস্তবোচিত নীতি মেনে পিপিপি মেডিক্যালে আসন বণ্টনের পক্ষে সওয়াল উঠেছে। প্রসঙ্গত, রাজ্যে আপাতত পিপিপি মডেলে চলে শুধু একটি মেডিক্যাল কলেজ— যাদবপুরের কেপিসি। সেখানকার অধ্যক্ষ বরুণ সাহা দালাল জানাচ্ছেন, তাঁদের দেড়শো আসনের ৫০টি ভর্তি হয় জয়েন্ট-তালিকা থেকে। ৭৭টিতে ম্যানেজমেন্ট কোটায়, নির্ধারিত ফি (যা এখন ছাত্রপিছু ২৯ লক্ষ টাকা) নিয়ে পড়ুয়া নেওয়া হয়। আর বাকি ২৩টি পূরণ হয় এনআরআই কোটায়, হাসপাতালের পরিচালন সমিতির বেঁধে দেওয়া অর্থের বিনিময়ে।

ধুবুলিয়া ও কোচবিহারে পিপিপি মেডিক্যাল কলেজের দায়িত্ব পেয়েছে ক্যামেলিয়া গ্রুপ। কার্শিয়াং ও ভাঙড়ে টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ। আসন ভর্তিতে লাভ-লোকসানের প্রসঙ্গে না-গিয়ে দুই সংস্থারই অবশ্য দাবি, তাদের দিক থেকে আগ্রহের খামতি নেই। বরং সরকারি পদ্ধতির ঢিলেমির কারণে অনেকটা দেরি হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। কী রকম?

টেকনো ইন্ডিয়া’র বক্তব্য: ভাঙড়ে গোড়ায় জমির সমস্যা ছিল। সেই জট কাটলেও ভূমি দফতর এখনও স্বাস্থ্যের হাতে জমি হস্তান্তর করতে পারেনি। যা শুনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার পাল্টা প্রশ্ন, ‘কার্শিয়াঙে তো আমরা জমি ঠিকঠাক করে দু’মাস আগে অফার লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি। তার জবাব আসছে না কেন?’’ এ বিষয়ে টেকনো ইন্ডিয়া’র তরফে গৌতম রায়চৌধুরীর ব্যাখ্যা, ‘‘কার্শিয়াঙে আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। কিছু নথিপত্র তৈরি বাকি। তাই বলে ভেবে নেওয়া ঠিক নয় যে, আমরা প্রকল্পে আর আগ্রহী নই।’’

পাশাপাশি ধুবুলিয়া-কোচবিহারেও এক ছবি। অন্য এক সংস্থা মামলা ঠুকে দেওয়ায় ধুবুলিয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অতি সম্প্রতি সেটা মিটেছে। আর কোচবিহারে তেমন কোনও সমস্যাই ছিল না বলে স্বাস্থ্য ভবনের দাবি। যদিও ক্যামেলিয়া গ্রুপের প্রধান নীলরতন দত্ত বলেন, ‘‘দু’টি প্রকল্প এক সঙ্গে শুরু না-করলে আমাদের পক্ষে লাভজনক হতো না। তাই ধুবুলিয়া-জটের কারণে কোচবিহারেও কাজে হাত পড়েনি। তবে প্রকল্প ছেড়ে দেওয়ার কথা আমরা ভাবছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন