রঙিন চুমুকে বসন্ত-মেজাজ 

বালিগঞ্জ চত্বরের একটি পেট্রল পাম্পের কাছে ছোট্ট একটা পানের দোকান এ সময়ে টেনে আনে নানা অঞ্চলের মানুষকে। পান না-খাওয়াদের ভিড়ই সেখানে বেশি।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০২:১২
Share:

সময়ে সময়ে বদলে যায় শহরের চিত্র। কয়েকটা দিনের জন্য নতুন প্রাণ পায় কিছু গলি। এক-দু’দিনের জন্য রূপ বদলায় ছোট্ট দোকান। কোনও এক ঝুপড়ির রং মাখা কাচের গেলাস তখন সবচেয়ে ট্রেন্ডি!

Advertisement

বালিগঞ্জ চত্বরের একটি পেট্রল পাম্পের কাছে ছোট্ট একটা পানের দোকান এ সময়ে টেনে আনে নানা অঞ্চলের মানুষকে। পান না-খাওয়াদের ভিড়ই সেখানে বেশি। পানের দোকান ভরে ওঠে ছোট ছোট কাচের গ্লাসে। হঠাৎ বলে যাওয়া চেহারা বলে দেয়, দোকানে ভিড়ের উদ্দেশ্য পান বটে। তবে পান পাতা নয়। পান নিয়ে ‘পান’ চলার মাঝেই আশপাশের রং থুড়ি ভাঙ-প্রেমীরা বলে দেবেন— ভাই বসন্ত যে এসে গেছে!

এ সময়টায় শহরের নানা অঞ্চলেই হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয় অচেনাদের ভিড়। দোল এক দিন। তবে শহরের কিছু কিছু গলিতে গোটা সপ্তাহ জুড়ে চলে বসন্ত উদ্‌যাপন। রঙে নয়, শরবতে। উত্তর কলকাতার ভূতনাথ মন্দিরের কাছে ঝকঝকে স্টিলের গেলাসে দুধ সাদা লস্যি কিংবা ঠান্ডাইয়ে চুমুক দিতে যেমন ভিন্‌ দেশের বন্ধুদের নিয়েও হাজির হয় শহর কলকাতার তরুণ বাহিনী।

Advertisement

বসন্ত কি শুধুই রং খেলার? কথায় কথায় গ্রিক সংস্কৃতির তুলনা টানা বঙ্গ সমাজ এ সময়টাতেও রীতিমতো আথেন্সমুখী। পছন্দের পানীয় ছাড়া এ শহরেও বসন্ত সাজে না ঠিক সেই তাদের মতোই। শহর কলকাতার অলিগলি বলে দেবে বসন্তের উৎসব মেজাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখে শরবতী মেজাজ। সল্টলেক থেকে যাদবপুর, বিধান সরণি, গোল পার্ক, ধর্মতলা, বড়বাজার— নানা চত্বরের দোল স্পেশাল ঠান্ডাই ও বিভিন্ন রঙিন শরবত নানা মুখে খ্যাত। আদি সে সব ঠেকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁ থেকে কফি শপও। পাড়ায় পাড়ায় রং-পিচকিরির দোকানের মতোই দিন কয়েকের রঙিন চুমুক উপহার দিতে বসন্তের মেনু কার্ড রাঙিয়ে তুলেছে রেস্তরাঁ মহল। কেউ লিচি শট, কেউ আম কিংবা পেয়ারা ফ্লেভারের লস্সি, কেউ বা লাল-কমলা রঙা মিল্ক শেক, কেউ আবার একই গেলাসে কয়েক রঙের তরল মিশিয়ে রঙ্গোলি শট কিংবা কিউয়ি ব্লাস্ট, অরেঞ্জ ব্লসমের মতো মকটেল নিয়ে তৈরি শহরকে হোলি হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলতে।

বাৎসরিক রঙিন হুল্লোড়ের পরে কয়েক পেয়ালা শবরত আজকের চল নয়। এ রীতি বহু কালের। যে সময়ের কলকাতার কথা প্রায় শোনাই যায় না এ শহরের কারও মুখে, সে সময়েও থাকত দোলের শরবতের বিশেষ আয়োজন। এ শহরে চলে আসার পরে ওয়াজিদ আলি শাহের বাড়িতেও জমিয়ে হত দোলের হুল্লোড়। থাকত রকমারি পান-ভোজনের ব্যবস্থা। রং খেলার পরে গোলাপ জল দেওয়া লস্সি আর টলটলে লাল রঙের ঠান্ডা পানীয়ের পেয়ালা হাতে মেটিয়াবুরুজ চত্বরের গলিতে নবাবের রঙিন উঠোনে বসত গান-বাজনার আসর। শহরের নামী জনেরা উপস্থিত থাকতেন সেখানে। সে সব কথা ইতিহাস না রাখলেও রঙে-সুরে-শরবতের সেই দোলের মেজাজটা এখনও দিব্যি ধরা আছে শহুরে বাঙালির মনে। দোল আসার দিন কয়েক আগে থেকেই মাঝেমধ্যে হলুদ-গোলাপি আবির মেখে বন্ধুর বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দায় ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে নাচ-গানের আসর। তাতেও সঙ্গী কখনও ঘরে তৈরি সিরাপ দিয়ে টলটলে শরবত কখনও বা আধুনিকা গিন্নির হাতে স্ট্রবেরি কিংবা ব্লুবেরি ফ্লেভারের শেক, লস্যি। দোলের দিনে এমনই কিছু বাড়িতে বছর বছর তৈরি হয় বাদাম-দুধ কিংবা পছন্দের ফলের রস মেশানো ঠান্ডাই।

কলেজের দিনের রঙিন হইচই ভুলতে না পারা এক দল মধ্যবয়স্ক বন্ধু-বান্ধবী এখনও আবার ঢুঁ মারেন দোলের সপ্তাহের কলেজ-পাড়ায়। কলেজ স্কোয়ার থেকে কয়েক পা দূরের এক চিলতে শরবত-ঠেক ঘিরে নস্ট্যালজিয়া এখনও টলটলে। দোলের দিনের আগে-পরে সেখানে জমে ডাব শরবত কিংবা তেঁতুলের শরবত নিয়ে তক্কো-গপ্পো। গোলপার্কের শরবত আখরাও তেমন ভাবেই ধরে রেখেছে দোলের খদ্দের। রোজ় সিরাপের বিক্রি তো এখনও এই দিনটা ঘিরে দ্বিগুণ হয় বলেই জানান সেখানকার দোকানিরা।

বাকি বছরটা বাঙালিয়ানায় ঘিরে রাখলেও এ সময়টায় মধ্য কলকাতার কিছু চত্বরে যথেষ্ট যাতায়াত বাড়ে অনেকের। নানা ফ্লেভারের সোডা শিকঞ্জি এ সময়টায় বিশেষ পছন্দের অনেকেরই। রং-জলে হুল্লোড়ের আগে পড়ে ভিড় জমে এলগিন রোডের আশপাশে নানা শবরত স্টলে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মশলা শিকঞ্জিতে চুমুক এখনও দোলের অঙ্গ।

রঙে-জলে এ ভাবেই মেতে উঠবে আরও এক দোল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন