নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি

আমাদের দেশের মহিলাদের সবথেকে বেশি জরায়ু মুখেই ক্যানসার হয়ে থাকে। মুশকিল হল এ রোগের উপসর্গ প্রকাশ পেতে কিছুটা সময় লাগে। তাই নিয়মিত পরীক্ষার দরকার। জানাচ্ছেন চিকিৎসক শঙ্করকুমার নাথ। সাক্ষাৎকার অর্পিতা মজুমদার।আমাদের দেশের মহিলাদের সবথেকে বেশি জরায়ু মুখেই ক্যানসার হয়ে থাকে। মুশকিল হল এ রোগের উপসর্গ প্রকাশ পেতে কিছুটা সময় লাগে। তাই নিয়মিত পরীক্ষার দরকার। জানাচ্ছেন চিকিৎসক শঙ্করকুমার নাথ। সাক্ষাৎকার অর্পিতা মজুমদার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৫
Share:

প্রতীকী ছবি।

প্রশ্ন: সারভাইক্যাল ক্যানসার বলতে ঠিক কী বোঝায়?

Advertisement

উত্তর: জরায়ুর একেবারে নীচের অংশকে বলে জরায়ুর মুখ বা ‘সার্ভিক্স অব দ্য ইউটেরাস’। এখানেই ক্যানসার হয়। একেই সারভাইক্যাল ক্যানসার বলে। এ দেশের মহিলাদের সব থেকে বেশি এই ক্যানসারই হয়। উন্নত দেশে এমনটা নয়। সেখানে আবার স্তনের ক্যানসারের প্রকোপ বেশি।

প্রশ্ন: আমাদের দেশের মহিলাদের তা হলে সারভাইক্যাল ক্যানসারের বিপদই বেশি?

Advertisement

উত্তর: না সেটা আর বলা যাচ্ছে না। কারণ, আমাদের দেশে স্তনের ক্যানসারের হারও বাড়ছে। আগে এমনটা ছিল না। কোনও কোনও রাজ্যে এখনই স্তন-ক্যানসারের হার, জরায়ু মুখের ক্যানসারের চেয়ে বেশি। সারা দেশে গড়ে অবশ্য জরায়ুর মুখের ক্যানসারই এক নম্বরে। তবে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যাতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এবং তা খুবই দুঃখের বিষয় হবে। কারণ, জরায়ুর মুখের ক্যানসার একেবারে শুরুতে ধরা পড়লে এবং চিকিৎসা শুরু হলে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়। কিন্তু স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে তা নয়। স্তন ক্যানসার শুরুতে ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে বহুদিন রোগীকে ভালো রাখা যায়। তবে নিরাময় অনিশ্চিত।

প্রশ্ন: কী থেকে বোঝা যায় জরায়ু মুখের ক্যানসার হয়েছে?

উত্তর: আগাম বোঝা মুশকিল। সে জন্যই এই ধরনের ক্যানসার দেরিতে ধরা পড়ে। ফলে চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়। ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়। কয়েকটি উপসর্গ দেখলে অবশ্য সতর্ক হতে হবে। যেমন, অস্বাভাবিক রকমের ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং হলে সতর্ক হতে হবে। মাসে এক বার পিরিয়ডের সময়ে ব্লিডিং স্বাভাবিক। কিন্তু দু’টি পিরিয়ডের মাঝে এক বার ব্লিডিং হলে বা পোশাকে দাগ হলে সতর্ক হতে হবে। মেনোপজের পরে ব্লিডিং, সহবাসের পরে বিল্ডিং, পরীক্ষা করার সময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের আঙুলে রক্তের দাগ— এগুলি সবই অস্বাভাবিক ব্লিডিং। আবার অস্বাভাবিক সাদা স্রাব, থকথকে সাদা এবং দুর্গন্ধ হলে ভাবতে হবে। এ ছাড়া, তলপেটে ব্যথা, পিরিয়ডের দিনগুলিতে প্রস্রাবের সময় ব্যথা— এ সব দেখে বোঝা যায়, বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। তবে মুশকিল হল এ সব উপসর্গ শুরুতেই আসে না। কিছুটা সময় পেরিয়ে আসে। তাই আগাম জানার ব্যবস্থা জরুরি।

প্রশ্ন: আগাম কী ভাবে আঁচ করা যেতে পারে?

উত্তর: পরীক্ষা করা দরকার। গোলমাল থাকুক বা না থাকুক, সব মহিলাকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। সে জন্য প্যাপ টেস্টে (PAP Test) করা দরকার। গড়ে তিন বছর অন্তর সব মহিলার তা করা উচিত। যাঁদের পরিবারে এমন ইতিহাস আছে, তাঁদের নিয়মিত করতেই হবে। বস্তি এলাকা বা গ্রামাঞ্চল, যেখানে দরিদ্র মানুষরা থাকেন, সেখানে অজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ মহিলার ‘ভ্যাজাইনাল পোর্সেন’ অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকে। তাই সংক্রমণ হয়। বিশেষ করে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচিপিভি) সার্ভিক্সে সংক্রমণ ঘটায়। এই ভাইরাস জরায়ু মুখে গিয়ে বাসা বাঁধে, বংশবৃদ্ধি করে। এর পরে সার্ভিক্সের সুস্থ কোষগুলিকে পাল্টে দিতে শুরু করে। কোষের ডিএনএ-কে আক্রমণ করে। ফলে কোষের পরিবর্তন হয়ে ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে।

প্রশ্ন: কী ভাবে পিএপি টেস্ট করা হয়?

উত্তর: চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী কাঠির আগায় তুলো দিয়ে সার্ভিক্স থেকে সামান্য রস তুলে নেন। তা কাঁচের স্লাইডে কিছুক্ষণ রাখা হয়। এর পরে তা গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। কোষের কোনও পরিবর্তন ধরা পড়লে তা হলে চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়। কারণ, এটা হল একটা ‘ওয়ার্নিং’। অর্থাৎ আর কিছু দিন এই অবস্থা থাকলে ক্যানসার হবে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে রোগ সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময় করা যায়। দেহের মধ্যে সার্ভিক্স একমাত্র জায়গা, যেখানে ক্যানসারের আশঙ্কা আঁচ করা যায়। অন্য কোনও ক্যানসারে কিন্তু এমনটা হয় না।

প্রশ্ন: পিএপি টেস্ট খরচ সাপেক্ষ। গরীব-দুঃস্থরা সমস্যায় পড়েন। অন্য কোনও টেস্ট আছে?

উত্তর: কম খরচের একটি টেস্ট আছে। সেটি হল ভিসুয়্যাল ইনস্পেকশন উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড (VIA Test)। অ্যাসেটিক অ্যাসিড বা ভিনিগার কাঠির আগায় তুলো দিয়ে সার্ভিক্সে লাগানো হয়। সাধারণত, সার্ভিক্সের রং হাল্কা গোলাপী। এ পরে কোনও অংশ যদি ফর্সা বা সাদা হয়ে যায় তা হলেই বুঝতে হবে তা ক্যানসার হওয়ার আগের অবস্থা।

প্রশ্ন: জীবনে চলার পথে কী কী সাবধানতা নিলে এই ক্যানসার থেকে দূরে থাকা সম্ভব?

উত্তর: কম বয়সে অর্থাৎ ১৬-১৭ বছরে সহবাস বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই নাবালিকার বিয়ে ও সন্তানধারণ রুখতে হবে। স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে চারের বেশি সন্তান না হওয়াই ভাল। সন্তান জন্মের ফলে বার বার সার্ভিক্স আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় বিপদ হতে পারে। এ ছাড়া বহুগামীতা, উদ্দাম জীবনযাপন ক্ষতিকর। জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত ‘ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল’ না খেয়ে অন্য কোনও পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। ধূমপান করলে তা বন্ধ করতে হবে। সব সময় পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে হবে। খাবারে ভিটামিন ও খনিজ না থাকলেও ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বেশি করে ভিটামিন-সি খেতে হবে। দৈনিক আধখানা করে পাতিলেবু খেলেও হবে। এ ছাড়া ফোলিক অ্যাসিড যুক্ত খাবার, যেমন স্ট্রবেরি, মটরশুঁটি—এ সবও খেতে হবে। তা হলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে ফেলা যায়।

প্রশ্ন: কী ভাবে চিকিৎসা হয়?

উত্তর: ক্যানসারের চিকিৎসা সাধারণত পাঁচ রকমের। অস্ত্রোপচার, রেডিয়োথেরাপি অর্থাৎ রেডিয়েশন দিয়ে, কেমোথেরাপি অর্থাৎ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা, হরমোন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি অর্থাৎ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। সার্ভিক্সের ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সার্ভিক্সের ক্যানসার স্টেজ-১-এ ধরা পড়ে গেলে অস্ত্রোপচার করা হয়। সার্ভিক্স-সহ ইউটেরাস পুরো বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, যাকে বলে র‌্যাডিক্যাল হিস্টরেক্টমি। অনেক সময় ফ্যালোপিয়ান টিউবও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওভারি দু’টিও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তবে ওভারি দু’টি অনেক সময় রেখে দেওয়া হয়, যাতে শরীরে হরমোনের প্রয়োজন মেটে।

প্রশ্ন: সার্ভিক্স ক্যানসারের সঙ্গে সন্তানধারণের সম্পর্ক কতটা?

উত্তর: অস্ত্রোপচারে ইউটেরাস বাদ দিলে সন্তান ধারণের সব সম্ভাবনাই শেষ। আবার অনেক সময় ইউটেরাস রেখে দিয়ে রেডিওথেরাপি করা হয়। কিন্তু তাতেও ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই এই রোগ নিরাময়ের জন্য সবার আগে মহিলাদের সদিচ্ছা দরকার। আমাদের দেশের মহিলাদের লজ্জ্বা তুলনায় বেশি। সে’সব দূর করে নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন