ভারতে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ধোঁয়া টানার কম্পিটিশনে গোল্ড মেডেলটা শেষ পর্যন্ত কলকাতার কপালেই জুটল! ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও অন্য শহরকে পেছনে ফেলে সিগারেট টানার ব্যাপারে অনেক এগিয়ে। নিকোটিনের আমেজ কাজে উৎসাহ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেস কমিয়ে দিতে পারে। আর এই কারণেই তাঁরা সিগারেটের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। কম-বেশি প্রায় প্রত্যেক ধূমপায়ীই এই যুক্তি খাড়া করেন। তবে কিছু কিছু তরুণীর সিগারেট টানার পেছনে আছে স্লিম হওয়ার যুক্তি। তবে একটা কথা প্রত্যেক সিগারেটপ্রেমীই খুব ভাল ভাবে জানেন যে তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ১০০ জন ধূমপায়ীর ৯৩ জনই ধূমপানের মারাত্মক দিক সম্পর্কে অবহিত। বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবসের আগে মুম্বই, অমদাবাদ, লখনউ, হায়দরাবাদ ও কলকাতায় সমীক্ষা করে জানা গেছে যে, প্রতি সপ্তাহে ধূমপায়ীদের গড় খরচ ৩৪৮ টাকা। আর তামাকপ্রেমীদের সংখ্যার বিচারে কলকাতা সবার ওপরে। সিগারেট ও তামাক সেবনকারীদের নিয়ে এক ন্যাশনাল সার্ভেতে জানা গেছে, কলকাতায় ধুমপায়ীর সংখ্যা সবথেকে বেশি। কলকাতায় ৪৯% এবং দেশের বাকি অংশে ৪৩%।
সিগারেট, বিড়ি-সহ তামাকের কুফল সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৭ সালে ৩১ মে বিশ্ব জুড়ে তামাক বিরোধী দিবসের ডাক দেয়। সেই থেকে ৩১ বছর ধরে বিড়ি, সিগারেট, গুটখা, খৈনি-সহ যাবতীয় তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে অনবরত প্রচার করা হচ্ছে। ইওরোপ-আমেরিকার মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়লেও আমাদের দেশে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জেনে অবাক লাগে যখন দেখা যায় ধূমপায়ীর তালিকায় আছেন বহু নামী-দামি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও (ক্যানসার চিকিৎসক, হার্ট স্পেশালিষ্ট, ইএনটি সার্জেন)।
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি-র এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে আমাদের দেশে ১০–১৪ বয়সি বাচ্চাদের মধ্যে ৬,২৫,০০০ ধুমপানের নেশায় আসক্ত। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১০ কোটি ৩০ লক্ষ ধূমপায়ী আছেন। এ দেশে তামাক ব্যবহারের আরও কয়েকটি দিক তুলে ধরেছে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি।
• প্রতি বছর ভারতবর্ষে ১০ লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু হয় শুধুমাত্র তামাক ব্যবহারের কারণে।
• ভারতবর্ষ দ্বিতীয় বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ।
• তামাক উৎপাদনের দিক থেকে এ দেশ তৃতীয় স্থানে।
• দেশের সমস্ত ক্যানসার রোগীদের ৫০ শতাংশই তামাক সেবন করেন। মুখের ক্যানসারের ৯০% ই সিগারেট, গুটখা ও অন্যান্য তামাকের নেশায় আসক্তি কারণে হয়।
• প্রায় ৯ কোটি পুরুষ ও ১.৩ কোটি মহিলা ধূমপান করেন।
• কলেজছাত্রীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এদের মধ্যে ২৭% প্রতি দিন ৫–১০ সিগারেট টানেন।
• ১৯৮০ সালে ৫৩ লক্ষ মহিলা ধূমপায়ী ছিলেন। ২০১২ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.২৭ কোটিতে। ক্রমশ বাড়ছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা। মা-বাবা হোক অথবা পাড়ার সেরা দাদা বা দিদিটিকে সুখটান দিতে দেখে ধূমপানে মজে যায় নতুন প্রজন্ম। বাড়ে নেশার দাসত্ব।
মোদ্দা কথাটা হল, মড়ার খুলির ছবিই হোক অথবা ক্যানসারে বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ, সব কিছুকে হেলায় তুচ্ছ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সিগারেট-বিড়ির নেশা ছড়িয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুন
তামাকে ক্ষতি চোখেরও, নেই সচেতনতা
সম্প্রতি দার্জিলিং পাহাড়ে প্রকাশ্যে ধূমপান আইন করেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়মভঙ্গ করলেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এর আগে কেরল ও চন্ডীগড়েও এই নিয়ম চালু করে ধূমপানের হার কমানো গেছে। স্কুল-কলেজের কাছে সিগারেট, বিড়ি-সহ যাবতীয় নেশার জিনিস বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে। সিগারেটের নেশায় দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একেবারে সামনের সারিতে। রাজ্যের জনসংখ্যার ৩৬.৩% ধূমপানে আসক্ত। এঁদের প্রায় সকলেই জানেন যে সিগারেটের বিষধোঁয়া ক্যানসারের হাতছানি থেকে আচমকা হার্ট অ্যাটাক-সহ হাজারো অসুখবিসুখের এক অন্যতম কারণ।
ধূমপানে আসক্ত এক বন্ধুকে এর কুফল সম্পর্কে দু’চার কথা বলায় সে অবলীলায় বলে দিল যে স্মোকিং করলে হার্ট অ্যাটাক কিংবা লাং ক্যানসার হবে তা নিয়ে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কিন্তু নন-স্মোকাররা কি জানেন, কোন ক্যানসার ওত পেতে বসে আছে তাঁদের কাবু করার জন্য! অন্য আর এক সহকর্মীর যুক্তি ছিল আরও ভয়ানক। চেন-স্মোকার সেই সহকর্মীকে সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা হাজার সাতেক খতরনাক রাসায়ানিকের বিষক্রিয়া সম্পর্কে বলার চেষ্টা করতেই সে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে থামিয়ে দিল। বলল, “কী দরকার জনে জনে বোঝানো, সিগারেট কোম্পানির চাকুরেদের চাকরিটা গেলে তাঁরা সংসার চালাবে কী ভাবে! তার চেয়ে অনেক সহজ, নিজেই নেশাটা ধরে ফেলা।” এই রকম মানুষজন সিগারেটের নেশায় এমনই মজেছেন যে তাঁদের কাছে ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’। একটা বড়সড় হার্ট অ্যাটাক বা ক্যানসারে আক্রান্ত হবার পরে তাঁদের টনক নড়ে। অনেকে আবার হার্টের বাইপাস সার্জারির পরেও সিগারেটের ধোঁয়ায় মজেন। ৩১তম বিশ্ব ধূমপানবিরোধী দিবসে আর এক বার তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া, একসময় না খেদোক্তি করতে হয়, ‘জীবন এতো ছোট কেনে’ বলে। আবার অনেকের ইচ্ছে থাকলেও হাজার চেষ্টা করেও ধোঁয়ার নাগপাশ এড়াতে পারেন না। যদিও তাঁরা ভাল করেই জানেন, ‘সিগারেট ক্ষতিকর নিকোটিন তামাকে,
আমি খাই সিগারেট, সিগারেট আমাকে।’