মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ঋতুস্রাব বন্ধ বয়ে গিয়েছে কসবার শ্রীতপা দাশগুপ্তর। প্রথমে ভেবেছিলেন, বিষয়টা সাময়িক। কিন্তু চিকিত্সকের কাছে গিয়ে যাবতীয় পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রাকৃতিক ভাবেই পুরোপুরি ‘মেনোপজ’ অর্থাত্ ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর।
একই ভাবে কয়েক মাস টানা ঋতুস্রাব বন্ধ থাকার পরে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা উনচল্লিশ বছরের বসুন্ধরা সমাজপতি। ভেবেছিলেন, হয়তো হিমোগ্লোবিন কমে গিয়েছে বলে এমন হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষার পর দেখা যায়, আসলে মেনোপজ হয়ে গিয়েছে বসুন্ধরার।
সাধারণত ৪৪-৫২ বছরের মধ্যে ঋতু বন্ধ হয় বলে ধরা হয়। কিন্তু চিকিত্সক ও গবেষকেরা বলছেন গোটা বিশ্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার মহিলাদের একটা বড় অংশের ঋতুস্রাব পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চল্লিশের নীচেই। চিকিত্সা-পরিভাষায় যাকে বলে ‘আর্লি মেনোপজ।’
‘জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা-২ এবং ৩’ অনুযায়ী, ভারতে এখন ১১ শতাংশ মহিলার ৪০ বছরে পৌঁছনোর আগে মেনোপজ হয়ে যাচ্ছে। চিকিত্সকদের কথায়, পঁয়ত্রিশ, ছত্রিশ বা চল্লিশে মেনোপজ হওয়া মহিলারা অল্প বয়স থেকেই হাড় ভঙ্গুর হওয়া, ত্বকের আর্দ্রতা নষ্ট হওয়া, হৃদরোগ, মাথাঘোরা, অনিদ্রা, যোনিপথের শুষ্কতা ও তার ফলে শারীরিক মিলনে সমস্যা, মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগের মতো নানা রকম শারীরিক সমস্যায় পড়ছেন এবং জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এঁদের বেশির ভাগেরই বেঁচে থাকার মান খারাপ হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ছ’টি জেলায় মেনোপজ হয়ে গিয়েছে এমন ৭১৫ জন বাঙালি মহিলার উপরে (যাঁদের মধ্যে ৩৭৪ জন কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনার) ২০১৩-১৪ সালে একটি সমীক্ষা চালান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগ ও ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’-এর বায়োলজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের গবেষকেরা। দু’সপ্তাহ আগে ‘আমেরিকান জার্নাল অফ হিউম্যান বায়োলজি’-তে সেই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৩০ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে মেনোপজ হয়ে গিয়েছে ১৫৭ জনের। অর্থাত্ মোট সংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ মহিলার। গবেষকেরাই জানিয়েছেন, সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতো।
২০১০-২০১২ সালের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিভাগ থেকে আর একটি সমীক্ষা হয় পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বাংলাভাষী আরও ৩৭১ জন মহিলার উপরে। ২০১৪ সালে ‘অ্যান্ট্রোকম অনলাইন জার্নাল অফ অ্যানথ্রোপলজি’-তে সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতেও দেখা গিয়েছে, প্রায় ৫২ শতাংশ মহিলার মেনোপজ হয়ে গিয়েছে ৪০ বছরের আগে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তা হলে কোন বিষয়গুলি ‘আর্লি মেনোপজ’ নির্ধারণ করছে বা কোন-কোন বিষয়ে নজর দিলে ৪০ এর নীচে মেনোপজ আটকানো যেতে পারে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের গবেষক শুভ রায় এবং দোয়েল দাশগুপ্তের ব্যাখ্যাযে সব মহিলার অনেক ছোটবেলায় ঋতুস্রাব শুরু হয়, তাঁদের ডিম্বাশয় তাড়াতাড়ি ডিম্বাণু-শূন্য হয় এবং মেনোপজ হয়ে যায়। তা ছাড়া, অল্প বয়সে সন্তান হলে, প্রথম ও শেষ সন্তানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কম হলে মেনোপজ তাড়াতাড়ি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং এন্ডোক্রিনোলজিস্টদের কেউ কেউ এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেছেন। আবার কেউ-কেউ অন্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। যেমন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট আশিস বসু এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর বলেন, “ঋতুমতী হওয়ার বয়স এগিয়ে আসাটা যেমন আর্লি মেনোপজের কারণ তেমনই পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ধরনও এর জন্য দায়ী। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়া, ব্যায়াম না-করা, রাত জাগা, ধুমপান, মানসিক চাপ, মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার মতো বিষয়গুলি এখানে প্রভাব ফেলতে পারে। এর থেকেই আজকাল মেয়েদের পলিসিস্টিক ওভারির মতো রোগ বেশি হয়। শরীরে রক্ত সংবহনও ব্যাহত হয়। ওভারি বা গর্ভাশয়ের ক্ষমতা কমেও দ্রুত মেনোপজ হতে পারে।”
মেনোপজ হয়ে গিয়েছে কলকাতার এমন ২৫০ জন মহিলার উপরে ২০১২ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা। তাতে দেখা গিয়েছিল, যে সব মহিলার মেনোপজ-উত্তর জীবনের দৈর্ঘ্য যত বেশি, তাঁদের জীবনধারণের মান তত খারাপ হয়েছে। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট নীলাঞ্জন সেনগুপ্ত এবং মৌটুসি রায়চৌধুরীর কথায়, “আজকাল মেয়েদের তাড়াতাড়ি ঋতুস্রাব শুরু হওয়াটা দ্রুত মেনোপজের একটা কারণ। আবার জিনগত কারণ, যক্ষ্মা, মাম্স-এর মতো রোগ এবং অপুষ্টি থেকেও আর্লি মেনোপজ হতে পারে।” মেনোপজ হলে কী কী শারীরিক-মানসিক সমস্যা হতে পারে এবং তা মোকাবিলার উপায় কী সে সম্পর্কে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে প্রচারাভিযান চালানো ও সরকারি হাসপাতালে বিশেষ ক্লিনিক খোলার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন চিকিত্সকেরা।