Old Building

বাঙালি-গন্ধ হারাচ্ছে ক্রমেই

শহর কলকাতার বহু পুরনো পাড়ায় প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে বাঙালির সংখ্যা। এই বদল হল কবে, কী ভাবে?বাঙালি-অবাঙালি এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ শহরের পাড়ায় পাড়ায় বসতবাড়ির হাতবদল হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৫১
Share:

প্রতীকী ছবি।

শোভাবাজার মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে আট কাঠা জমিতে প্রায় একশো কুড়ি বছরের বাড়ি। চুন-সুরকি খসে পড়ছে। ছাদও তথৈবচ! কিন্তু সংস্কারের বদলে বাড়ির দাবিদারেরা পূর্বপুরুষের করে যাওয়া ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’র তকমা মুছতে ব্যস্ত।

Advertisement

পিসতুতো ভাইয়ের প্রোমোটারকে পছন্দ নয় বাড়ির সেজো এবং মেজো কর্তার ছেলেদের। বাকিরা পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গেই রয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, “একে অবাঙালি প্রোমোটার। তায় প্রচুর টাকা। ইতিমধ্যেই দেবোত্তর সম্পত্তির তকমা ঘোচাতে মামলা করে ফেলেছেন। কিছু দিতে হবে না, উল্টে সবাই কোটি টাকার ফ্ল্যাট পাব।” সেজো এবং মেজো কর্তার ছেলেদের যুক্তি, “বন্ধুকে ‘ইয়ার’ আর ঢ্যাঁড়সকে ‘ভেন্ডি’ বলা লোক দিয়ে কাজ করাব না। আমাদের জমি। অথচ বেশিটা পাবে অন্য লোকে!” কথা কাটাকাটির মধ্যেই পিসতুতো ভাইয়ের মন্তব্য, “তালপুকুরে ঘটি ডোবে না, আবার বড় বড় কথা!”

বাঙালি-অবাঙালি এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ শহরের পাড়ায় পাড়ায় বসতবাড়ির হাতবদল হয়ে যাচ্ছে। সম্ভ্রান্ত পাড়ার বহু বাড়িই হয় মালিকদের টাকার অভাবে সংস্কার হচ্ছে না, নয়তো শরিকি বিবাদে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এর পরে হয় প্রোমোটারের দেওয়া ছোট ফ্ল্যাটে উঠছেন মালিক পক্ষ, নয়তো বাড়ি বিক্রির টাকা বুঝে শহরতলিতে ফ্ল্যাট কিনছেন। সেই জায়গায় যে বহুতল উঠছে, তার এক একটি ফ্ল্যাটের দাম এতই বেশি যে, বহু ক্ষেত্রেই তা মধ্যবিত্ত বাঙালির নাগালের বাইরে। উত্তরের অরবিন্দ সরণির এমনই এক বাসিন্দার কথায়, “কয়েক বছর আগে এ জিনিস হাওড়ায় শুরু হয়েছিল। এখন কলকাতার প্রায় সব পাড়ায় এক অবস্থা। আমহার্স্ট স্ট্রিট, রাজবল্লভপাড়া, সুকিয়া স্ট্রিটের মতো বাঙালি পাড়াতেও নতুন ওঠা ফ্ল্যাটে বাঙালি পরিবার ক’টা! এ ভাবেই আমাদেরটাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে।” ভবানীপুর এলাকার এক রাজনৈতিক কর্মীর মন্তব্য, “এখানে বহু দিন থেকেই অবাঙালির ভিড়। হিসেব করে দেখেছি, এখানকার প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচ বছর আগের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ করে বেশি অবাঙালির বাস বেড়েছে। নতুন বসতবাড়ি কেনার লড়াইয়ে পেরে উঠছে না বাঙালি।”

Advertisement

বস্তি এলাকার চিত্র আবার অন্য। উত্তর থেকে দক্ষিণের একাধিক পাড়ার বেশির ভাগ জায়গায় বেআইনি নির্মাণের রমরমা। আগে যে একতলা বাড়িতে সাত ঘর থাকত, নির্মাণের পরে এক-একটি তলে অন্তত চারটি পরিবার উঠছে। যারা বেশির ভাগই অবাঙালি। যাদবপুর শ্রীকলোনির এমনই এক প্রোমোটার বললেন, “বাঙালি হলে ঠিকা জমির বাড়ি প্রতি বর্গফুটে ৩০০০ টাকা হিসেবে বিক্রি করি। ভিন্ রাজ্যের লোক পেলে সেটাই সাড়ে চার হাজার টাকা বর্গফুটের কমে দেওয়া হয় না।” পার্থক্যের কারণ? তাঁর দাবি, “ভিন্ রাজ্য থেকে আসা লোকের পরিবারে অনেক সদস্য। তাই এঁরা একসঙ্গে একাধিক ফ্ল্যাট কেনেন। ফলে প্রথমেই দাম বাড়িয়ে রাখলে লাভ বেশি।” টালিগঞ্জের রানিকুঠি এলাকার এক প্রোমোটারের মন্তব্য, “সব প্রোমোটারের কাছেই অবাঙালি খদ্দেরের গুরুত্ব বেশি। এ শহরে একটা ঠিকানা পেতে ওঁরা যত টাকা দিতে রাজি থাকেন, বাঙালি অত দেবেন নাকি?” কাঁকুড়গাছি এলাকার ‘হরিয়ানা’ নামে এক চায়ের দোকানের মালিকের একারই ওই চত্বরে ফ্ল্যাট সাতটি! ওই চা বিক্রেতার দাবি, “বিহারের ছাপরা থেকে ১৬ বছর আগে কলকাতায় এসেছিলাম ১৭ জন। এখন পরিবার আরও বেড়েছে। এত দিনে সুযোগ হয়েছে। তাই কিনে রেখেছি।” একই দাবি বদ্রীদাস টেম্পল স্ট্রিটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ত্রিভুবন জয়সওয়ালের। ওই পাড়াতেই তাঁর নামে চারটে বাড়ি রয়েছে। বললেন, “ছেলে প্রোমোটিংয়ে নেমেছে। বাড়ি কেনাবেচা তো চলতেই থাকে। দেশের বাড়ি থেকে লোক এলে তাঁদের তো থাকতে দিতে হয়!”

নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ক্রেডাই’-এর পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি সুশীল মেহতার দাবি, “এক কালে পূর্বপুরুষ অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন, এখন আমরা ভূমিপুত্র। অবাঙালি ক্রেতা আগের চেয়ে বাড়লেও বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কিন্তু বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই।” এক নামী নির্মাণ সংস্থার বাঙালি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইন্দ্রজিৎ রায় যদিও বললেন, “এক দল থাকবেন বলে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনেন, অন্য দল কেনা জায়গা বিক্রি করে মুনাফা করতে চান। দু’ক্ষেত্রেই অবাঙালির দাপট। লকডাউনের পর থেকে দেখছি, জায়গা-দাম দেখছেন না, শুধু টাকা ঢালতে অবাঙালির ভিড়।”

লেক টাউনের একটি আবাসনের একমাত্র বাঙালি পরিবারের সদস্য, ব্যাঙ্ককর্মী সুবিমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “ভূমিপুত্র আর বহিরাগত, গুলিয়ে যাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে তো সর্বক্ষণ অন্য ভাষাই শুনছে। হয়তো এক দিন বলতে হবে, ওদের ঠিক বাংলা আসে না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন