অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
ঈশ্বরবিশ্বাসীর বহু তত্ত্ব আছে। তার মধ্যে একটি হল ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। এ জগতের বাকি সমস্তই তাঁর মায়াকল্প। এক থেকে তিনি বহু হলেন। কেন? ঈশ্বর যেমন স্বয়ং এই তত্ত্বের উদ্গাতা নন, তেমনই তার ব্যাখ্যাকারও নন। অতএব মানবমন নিজস্ব অনুভবের নিরিখে দ্বিবিধ কারণ নির্ণয় করে। এক, ঈশ্বর একাকীত্ব বোধ করছিলেন। দুই, সৃজনপ্রেরণা তাঁকে এক থেকে বহু করেছে।
মানব নিজস্ব নীতি, চিন্তা, দর্শন, প্রত্যাশা— সমস্তই দেবতায় আরোপ করে। ঈশ্বরিক আদেশ-নির্দেশ, ক্ষমতা ও মহত্ত্ব আসলে মানবের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। সেই আরোপগুলির মধ্যে অন্যতম এক থেকে বহু হওয়ার কল্পব্যাখ্যা। কারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে, এক থেকে বহু হওয়া জৈবিক প্রবণতা। অত্যন্ত বাস্তব এবং সর্বজীবে প্রযোজ্য। পিঁপড়ে, মৌমাছি, হাতি বা কাকপক্ষীর মতো মানুষকেও সমাজবদ্ধ প্রাণী মনে করা হয়। আবার নব্য সমাজের রীতিতে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমরা’ নয়, এখন মূল ভাবনায় থাকে ‘আমি’।
এই আমিত্ব সচেতনতাও খুব নতুন নয়। আমি আছি বলেই জগত্ আছে। এই ভাবনার প্রমাণ আমাদের উপনিষদে রয়েছে। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কেবল আমিত্ব মাত্র নয়। আমিত্বর অস্তিত্ববাদ ছাড়িয়ে এ হল সমাজের অন্তর্ভুক্ত এক জন সদস্য হিসেবে নিজস্ব রুচি, অভিমত ও ইচ্ছার নিরবচ্ছিন্ন অভিক্ষেপ। সব মিলিয়ে এক বৃত্ত। এক থেকে বহু, বহুর ভিতর এক। ব্যাপারটা এমন যেন একাকী থেকে দ্বৈত, দ্বৈত থেকে বহুর মধ্যে ‘এক’-এর বিজন বীজখানির লয় ক্ষয় নেই। কোনও অসন্তোষ বা সন্তোষ, কোনও বিক্ষোভ বা তৃপ্তি, কোনও তত্ত্ব, স্বার্থবুদ্ধি কিংবা নিছক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অনন্য অবদানে এক এবং বহু-র দ্বন্দ্ব কিংবা সহাবস্থান, দুই-ই বিচিত্র ভাবে প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুন: এই একা হওয়া আমাদের প্রার্থিত ছিল না তো!
আদিম যৌথজীবন থেকে পারিবারিকতার একক নিয়ে গঠিত বর্তমান সামাজিক অবস্থানে পৌঁছতে প্রায় কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তন ঘটাতে হয়েছে। স্মার্ট ফোনে হুমড়ি খেয়ে পড়া ছেলেটি বা মেয়েটি চারপাশের অস্তিত্ব ভুলে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখছে, সমাজের এই সাম্প্রতিক দৃশ্যও আসলে ঠিক ‘একাকিত্ব’-র উদাহরণ নয়। বিচ্ছিন্নতাও একে বলা চলে না। কারণ পরিপার্শ্ব-বিস্মৃতি ঘটলেও প্রযুক্তি দূরতর বন্ধনকে দৃঢ়তর করে চলেছে। ‘একাকিত্ব’ আসলে এক বোধ, যা মানবজাতি সচেতনার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আদিকাল বলে যদি সভ্যতার কোনও সূচনা-বিন্দু থাকে, তখন থেকেই তা বিরাজমান। এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা দুরূহ, ব্যাখ্যা কঠিন।
আরও পড়ুন: দেখা হলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দুর্গাপুরের গল্প শুনতে চাইতেন সুবোধকাকু
মানুষের ভোগপ্রবণতার দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিপাত করলে যে স্বার্থান্বেষ বা আত্মপরায়ণ ভাব প্রকটিত হতে দেখা যায়, তা, পরিস্থিতি সাপেক্ষে স্বতন্ত্র থাকার উদ্দেশ্যই ব্যাখ্যা করে। মানুষের আজকের চরিত্র লক্ষ লক্ষ বত্সর ধরে জিনে লিখিত ভাষার প্রকাশ, নিরন্তর তার পরিবর্তন চলছে, তবু আদিমতা লুপ্ত হয়নি। জীবন ও জগৎকে স্বতন্ত্র ভোগ করাই যদি মানবের উদ্দেশ্য, তা হলে কেন আদিম যৌথসমাজ গড়ে উঠেছিল? এক, নিজ সন্তানাদি বা মানবকের মধ্যে আপন প্ররূপ লক্ষ্য করে আত্মমায়ার আচ্ছন্নতা; দুই, আত্মরক্ষা বা নিরাপত্তার বাস্তব কারণ! অনুভূতি ও চেতনা যত ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে, তার জটিলতাও বেড়েছে। কে আমি বা কী আমি-র উত্তরে অবশিষ্ট জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে ‘আমি’-র প্রতিরূপকে আদ্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই কিছু। নিজেকে জানার জন্যই অপরকে জানা, নিজেকে পাওয়ার জন্যই অপরকে চাওয়া— এই ধ্রুব বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি নেই। নিজেকে অন্যের কাছে কোনও উপায়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার ভিতর দিয়ে সেই বন্ধন তৈরি হয়। ব্যক্তি ও জগতের বন্ধন। এই বন্ধনই দেয় জীবনের অর্থ ও নিরাপত্তা। এমনকী, স্বাতন্ত্রবিশ্বাসী ব্যক্তিরও থাকে এক জগত্। তাই প্রিয়জনবিচ্ছেদ বা মৃত্যু এত দুঃখের। কারণ জগত্ অর্থে মহাবিশ্ব বা পৃথিবীবলয় না-ও হতে পারে। দু’জন ব্যক্তিও এক জগত্। পোষা প্রাণী ও প্রভু এক জগত্। একটি কম্পিউটার ও ব্যবহারকারী এক জগত্।
নিজস্ব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে না পারার ভিতর নিহিত থাকে একাকীত্বর বীজ। তা নিরাপত্তাহীনতাই হোক কিংবা নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করাই হোক। ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’× এ প্রশ্ন থেকে ক্রমাগত দূরত্ব রচনাই আসলে জীবন। এমনকী ঈশ্বর, এমনকী বৈজ্ঞানিক, এমনকী নাস্তিক, কেউ এই প্রশ্নের হাত থেকে মুক্তি পায় না, কারণ, জীবন শেষ পর্যন্ত ফুরোয়। এ সত্যিই বিস্ময়কর, কিছুই থাকবে না জেনেও আগলে বসে থাকা।
একাকিত্ব বোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অবসাদের। অবসাদ অনেক সময় মৃত্যু ডেকে আনে। বিচ্ছিন্ন মৃত্যু, সপরিবার মৃত্যু। প্রায়ই এমন ধরনের খবর প্রকাশ পায়। এই সমস্ত অবসাদ, একাকিত্ব, আত্মহত্যা বা হত্যার কারণ সর্বোত মানসিক, এমনটাও নয়। বিবিধ মৌল উপাদান এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির হ্রাস-বৃদ্ধি শরীরে যেমন উত্পাত ঘটায়, তেমনই শরীরী সংঘটনের অংশ হিসেবে মনের গতিপ্রকৃতিও নিয়ন্ত্রণ করে।
ঈশ্বর থেকে মানুষ, একাকিত্ববোধ প্রত্যেকের নিয়তি। মাতৃহীন বালিকা, বিপত্নীক পুরুষ, বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরিত বাবা-মা, ঋণজর্জর ব্যর্থ ব্যক্তিমাত্রই নয়, একাকিত্ব এক অদৃশ্য শক্তিমান দৈত্য। কখন, কার স্কন্ধে চেপে বসে, তাকে দিয়ে কী করিয়ে নেয়, বড়ই অনিশ্চয়।
বোধহয়, যূথবদ্ধতাই এর উত্তর। চার দেওয়ালের নিষেধ ভেঙে বন্ধুত্বের পরশ নেওয়াই এর উপশম। যদি একা লাগে, হাত রাখো অন্য কারও হাতে। আর কিছু না হোক, অন্ন দাও অভুক্ত শিশুটির পাতে। শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে-ই একা।