বিপন্ন শৈশব, বাবা-মাকে বোঝাবে কে

পড়া, খেলা, নাচ-গান— সবেতেই প্রথম হওয়ার চাপ। কোথাও পিছিয়ে পড়লে, কোনওটায় ভুল করলেই যেন কেলেঙ্কারি। অন্যের সঙ্গে তুলনা, বকাঝকা, মারের উদাহরণ ঘরে ঘরে। যে সঙ্কটে রীতিমতো জর্জরিত শৈশব-কৈশোর।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০৭:৪০
Share:

মন খারাপ স্নিগ্ধার। পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। খুড়তুতো দাদা, মামাতো দিদির থেকে কম নম্বর তার। নিজের ক্লাসে প্রথম হলেও, বাড়িতে সে যে লাস্ট। বাবা-মায়ের মুখ রাখতে পারল না যে সে!

Advertisement

মাসতুতো দিদিরা পড়াশোনায় ভাল। অত পড়তে ভাল লাগে না সৌরভের। ভরসা শুধু ভাই। ভাই ভাল রেজাল্ট করলে বাবা-মায়ের মন ভাল থাকবে। সৌরভ কম পড়লেও চলবে।

স্নিগ্ধা বা সৌরভ বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। এমন শিশু-কিশোরেরা প্রায় সকলেরই পরিচিত।

Advertisement

বছর কয়েক আগের কথা, টেবিল টেনিস খেলায় আরও ভাল ফলের জন্য চাপ ছিল স্কুলপড়ুয়ার উপরে। একটু পিছিয়ে পড়তেই জুটত মার। এক দিন সেই মারেই প্রাণ হারায় বেহালার ওই কিশোর।

পড়া, খেলা, নাচ-গান— সবেতেই প্রথম হওয়ার চাপ। কোথাও পিছিয়ে পড়লে, কোনওটায় ভুল করলেই যেন কেলেঙ্কারি। অন্যের সঙ্গে তুলনা, বকাঝকা, মারের উদাহরণ ঘরে ঘরে। যে সঙ্কটে রীতিমতো জর্জরিত শৈশব-কৈশোর।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে একটি ভিডিও। বছর চারেকের এক শিশুকে কেঁদে কেঁদে বলতে দেখা যায়, ‘‘আপ পেয়ারসে পড়াইয়ে...।’’ একটু ভালবেসে পড়ানোর সেই আর্তি দেখে নড়ে বসেছে এ রাজ্য। ঠিক হয়েছে ভালবেসে পড়ানোর পাঠ দেওয়া হবে শিক্ষকদের। প্রশ্ন উঠেছে, তাতে না হয় কিছুটা সহানুভূতিশীল হবেন শিক্ষকেরা, কিন্তু বাবা-মায়েদের বোঝাবে কে?

অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপ ইতিমধ্যে উঠে এসেছে বিজ্ঞাপনের থিমেও। নরম পানীয়ের এক বিজ্ঞাপনী ছবিতে বাবা-মায়েদের খোলা চিঠি লিখেছিল কিশোর-কিশোরীরা। যা দেখে অপরাধবোধে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন ছবির সেই অভিভাবকেরা। কিন্তু বাস্তবটা সামলানো হবে কী ভাবে?

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ মনে করান, বিদেশে সন্তানের জন্মের আগে অভিভাবকত্বের প্রস্তুতি বেশ প্রচলিত। তার জন্য রীতিমতো পাঠ নেন তরুণ-তরুণীরা।

অনেকেই বলেন, বাবা-মা হওয়া মুখের কথা নয়। তাঁদের চিন্তা শুধু তাঁরাই বোঝেন। পায়েল বলেন, ‘‘মুখের কথা নয় বলেই খুব সাবধান হওয়া দরকার প্রতি পদে। নিজেদের চিন্তা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন সন্তানের উপরে চাপ সৃষ্টি না করে, খেয়াল রাখতেই হবে।’’

তবে কি সন্তানকে পথ দেখাবেন না অভিভাবক?

পথ দেখানো আর চাপ সৃষ্টির ফারাকটাই খেয়াল করার। মনে করাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। গল্পের ছলে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখানো আর তা ঘিরে আতঙ্ক তৈরির মধ্যে যে অনেকটা ফাঁক আছে। মনোরোগের চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম যেমন মনে করেন, এগিয়ে চলার জন্য বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা খুবই প্রয়োজনীয়। তবে সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘শিশুর কতটা করতে পারে, আগে তা বুঝে নিতে হবে অভিভাবককে। সেই অনুপাতে অনুপ্রেরণা দেওয়া দরকার।’’ শিশুর ক্ষমতা বুঝতে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখা উচিত বলে মনে করেন চিকিৎসক। জয়রঞ্জনবাবু মনে করান, সকলে মিলে একটি শিশুকে বড় করলে তার উপরে চাপও কম পড়ে।

একই কথা মনে করান সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র।
তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাবা-মা, সন্তান সকলেই একাকিত্বে ভুগছেন। তাই অভিভাবক দুশ্চিন্তা করছেন, সন্তান সমাজে জায়গা করতে পারবে কি না। সেই চাওয়া যে কখন মাত্রা ছাড়াচ্ছে, সেইটাই বুঝছেন না অনেকে।’’ তাতেই বাড়ছে চাপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন