রাত পোহালেই পুরভোট। ঠিক তার আগেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কার্যত কল্পতরু হওয়ার ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুক্রবার ফেসবুকে তিনি ঘোষণা করেছেন, এ বার থেকে সব ধরনের ক্যানসার, হার্টের সমস্যা এবং রক্তের নানা সমস্যার চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় করা হবে। শুধু চিকিৎসক মহল নয়, মমতার এই আকস্মিক ঘোষণায় বিস্মিত স্বাস্থ্যকর্তারাও।
তাঁদের বক্তব্য, বিষয়টি এখনও পর্যন্ত স্রেফ আলাপ-আলোচনার স্তরে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আচমকাই তা ঘোষণা করে দেওয়ায় এ বার তাঁদের আরও বেশি বিব্রত হতে হবে বলে মনে করছেন দফতরের শীর্ষকর্তাদের একটা বড় অংশ। তাঁদের প্রশ্ন, অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই চিকিৎসাগুলি সার্বিক ভাবে বিনামূল্যে করতে গেলে রাজ্যকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, তা বাস্তবে কতটা সম্ভব? এই ঘোষণায় কতটা সারবত্তা রয়েছে, আর কতটাই বা রাজনৈতিক চমক, প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়েও।
রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে অবাস্তব বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘চালু প্রকল্পগুলিই মুখ থুবড়ে পড়ছে। স্টেট ইলনেস অ্যাসিস্ট্যান্স ফান্ডের সুবিধাই পাচ্ছেন না বহু গরিব রোগী। তার মধ্যে আবার নতুন প্রকল্প ঘোষণা হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা চিকিৎসক মানস ভুঁইয়ার গলাতেও অবিশ্বাসেরই সুর। তিনি বলেন, ‘‘যেখানে বিনামূল্যে সাধারণ অসুখের চিকিৎসাই করা যাচ্ছে না, সেখানে এত ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা কী ভাবে বিনা পয়সায় হবে তা বুঝতে পারছি না।’’ মানসবাবুর বক্রোক্তি, ‘‘গত চার বছরে রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলির কী হাল সে ব্যাপারে খোঁজ নিলেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিনের ঘোষণার কী পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়।’’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এতে অবাস্তব কিছু দেখছেন না। রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে এ দিন সন্ধেয় নবান্ন ছাড়ার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘দুয়েক মাসের মধ্যেই সব হয়ে যাবে।’’ স্বাস্থ্য-কর্তাদের মধ্যে এখন দায় এড়ানোর লড়াই শুরু হয়েছে। এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘বিষয়টি কী ভাবে রূপায়ণ করা হবে, তার কোনও ধারণা নেই।’’ অন্য এক কর্তার কথায়, ‘‘আগে প্রকল্প তৈরি হোক, তার পর বলতে পারব।’’ প্রকল্প কার্যকরী হতে কত সময় লাগবে? তাঁর জবাব, ‘‘সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।’’ এ জন্য স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কত বাড়াতে হবে? তারও কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। যে স্বাস্থ্যকর্তার সঙ্গেই কথা হয়েছে, প্রত্যেকেই অনুরোধ করেছেন, ‘‘আমাদের নাম উল্লেখ করবেন না। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।’’
ইতিমধ্যেই জেলা স্তর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড তুলে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ফ্রি করা হয়েছে পরীক্ষাও। তাতেই রোগী কল্যাণ সমিতির আয় অনেকটা কমে গিয়েছে। রোগী কল্যাণ সমিতির টাকায় সরকারি হাসপাতালগুলির অনেক খরচই উঠে আসে। এ বার ক্যানসার, হার্টের চিকিৎসা ফ্রি হলে কোষাগার শূন্য হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা অনেকেরই।
দফতরের অন্য এক কর্তা বলেন, ‘‘ক্যানসার চিকিৎসা বা হার্টের অস্ত্রোপচার— সরকারি স্তরে খুব কম জায়গাতেই হয়। ফলে ‘রাজ্যের সব হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা করা হবে’ বলে যে ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে যথেষ্টই অস্পষ্টতা রয়েছে।’’
দরিদ্র রোগীদের জন্য ক্যানসারের কেমোথেরাপির খরচ আগেই মকুব করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। এ বার গোটা চিকিৎসা প্রক্রিয়াটাই নিখরচায় হওয়ায় ঘোষণাকে প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কী ভাবে অর্থের সংস্থান হবে, কত দিন প্রকল্প চালানো যাবে, সে সব পরের প্রশ্ন। সরকার যে এমন প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাই যথেষ্ট অভিনন্দনযোগ্য।’’ বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি, সেরে যায় এমন অনেক ক্যানসারের চিকিৎসাও বহু মানুষ করাতে পারেন না স্রেফ টাকার অভাবে। সরকার যদি তাঁদের দায়িত্ব নেয়, তা হলে তার চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না।’’
গরিব রোগীদের জন্য নিখরচায় পেসমেকার এবং স্টেন্টের ব্যবস্থা হয়েছে আগেই। তাই নিয়ে এখনও পর্যন্ত বহু প্রতিরোধ সামলাতে হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে। হার্টের বড়সড় অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম ন্যায্যমূল্যের দোকানে প্রায়শই পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে নিখরচায় চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হবে কী ভাবে? বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তারের যে ঘাটতি, সেটাই বা রাতারাতি মিটে যাবে কী ভাবে? কার্ডিওলজিস্ট বিশ্বকেশ মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা প্রস্তাব তৈরি করে স্বাস্থ্য ভবনে জমা দেব। তার পরে ওঁরা সেটা জানাবেন। দেখা যাক কী ভাবে হয়।’’
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ভবনে স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক হয় বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, ক্যানসার, হার্টের চিকিৎসা বিভাগের প্রধানদের। সেখানে স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, ক্যানসার, হার্ট এবং রক্তের চিকিৎসা ফ্রি করার কথা ভাবা হচ্ছে। যে ভাবেই হোক তা করতে হবে। এর পরের ধাপে কিডনির চিকিৎসাও নিখরচায় করা হবে বলে জানানো হয়।
বৈঠকে উপস্থিত অধ্যক্ষ এবং বিভাগীয় প্রধানরা এই প্রস্তাব শুনে আতান্তরে পড়ে যান। তাঁরা জানতে চান, এ জন্য যে বিপুল পরিকাঠামো প্রয়োজন তা কী ভাবে তৈরি হবে? ডাক্তারের অভাবের প্রসঙ্গও তোলেন তাঁরা। ডাক্তারের অভাবে নিখরচায় শিশুদের হার্টের অস্ত্রোপচার করার শিশুসাথী প্রকল্প কী ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে, বলা হয় সেটাও। স্বাস্থ্যকর্তারা তাঁদের বলেন, ‘‘কোনও কথা শুনতে চাই না। যে ভাবে হোক, ব্যবস্থা করতে হবে। টাকটা সমস্যা নয়।’’
কী ভাবে হবে অর্থের সংস্থান? দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায় সেই প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব মিলেছে। তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের খাতে প্রচুর টাকা আসছে। সেই টাকা খরচ করে ওঠা যাচ্ছে না। সেই টাকা খরচের জন্যও তো কিছু নতুন প্রকল্প দরকার। এতে সুনামও হবে, আবার নিজেদের টাকাও খরচ হবে না।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ফেসবুক ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে অন্য একটি বিষয়েও। ভোটের ঠিক আগের দিন এমন জনমোহিনী নীতি ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করলেন কি না, প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়েও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূযর্কান্ত মিশ্র বিষয়টি নির্বাচনী বিধিভঙ্গ বলেই মনে করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভোটের আগের দিন এক জন মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে এমন বলতে পারেন জানি না।’’
এ ব্যাপারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখব। নির্বাচনী বিধিভঙ্গ হলে ব্যবস্থা নেব।’’ কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন? দফতরসূত্রে খবর, কমিশন বড়জোর মুখ্য সচিবের কাছে চিঠি দিয়ে কেন এমন হল, তা জানতে চাইতে পারে। এর চেয়ে বেশি তাদের কিছু করার নেই।