আশ্বাসই সার, নিখরচার ওষুধ পেতে হয়রানি

মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন, তাই সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার, হার্ট এবং রক্তের জটিল অসুখের চিকিৎসার সমস্ত খরচ মকুব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু যেগুলো আগে থেকেই নিখরচায় পাওয়ার কথা, সেই সব ওষুধপত্রও যে রোগীদের হাতে ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না, কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে সেই ছবিই উঠে এসেছে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০২:১৫
Share:

মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন, তাই সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার, হার্ট এবং রক্তের জটিল অসুখের চিকিৎসার সমস্ত খরচ মকুব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু যেগুলো আগে থেকেই নিখরচায় পাওয়ার কথা, সেই সব ওষুধপত্রও যে রোগীদের হাতে ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না, কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে সেই ছবিই উঠে এসেছে।

Advertisement

দেখা গিয়েছে, হাসপাতালের ফার্মেসিতে যে সব ওষুধ থাকে, ডাক্তারেরা হামেশাই তার বাইরের অন্য ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। প্রায়ই হাসপাতাল চত্বরের ন্যায্য মূল্যের দোকানেও সেই ওষুধগুলি পাচ্ছেন না তাঁরা। ফলে নিখরচায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে ওষুধ কেনার জন্য সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু পরিবারকেই। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না করে রাতারাতি ব্যয়সাপেক্ষ বিভিন্ন চিকিৎসার খরচ মকুবের সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যত কাজের কাজ কিছুই হবে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি বড় অংশও।

এসএসকেএম হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি অগ্নিদগ্ধ তাপসী হালদারের (নাম পরিবর্তিত) জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন লিখে দেওয়া হয়েছে, তার এক-একটির দাম প্রায় দেড় হাজার টাকা। ইঞ্জেকশনটি হাসপাতালের ফার্মেসিতে নেই। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে যে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়, তাতে পোড়ার ওই গভীর ক্ষত শুকোবে না। সংক্রমণের ভয় আছে। ইঞ্জেকশনটির দু’সপ্তাহের কোর্সের জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে, বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করে সংসার চালানো ওই পরিবারের পক্ষে তা দেওয়া অসম্ভব। হাসপাতালের সুপারের অফিসে নিখরচায় ওষুধের জন্য লিখিত আবেদন করেছে তাপসীর পরিবার।

Advertisement

একই অবস্থা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি এক দিনমজুর রোগীর। তাঁর পায়ে ধাতব প্লেট বসানোর প্রয়োজন ছিল। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী (বিপিএল) ওই রোগীর চিকিৎসা পুরোটাই নিখরচায় হওয়ার কথা। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে ধাতব প্লেটের জন্য। টাকা না দিলে অস্ত্রোপচার হবে না।

যেখানে কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপির বা ওপেন হার্ট সার্জারির মতো ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসার খরচ মকুবের ঘোষণা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে, সেখানে ২০-২৫ হাজার টাকার চিকিৎসা আটকে থাকছে কেন— প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।

২৭ বছরের মিনু নস্কর তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা, দুর্বলতা, মাথা ঘুরে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলেন বাঙুর হাসপাতালের আউটডোরে। চিকিৎসক তাঁকে দেখে জানান, প্রবল অ্যানিমিয়ার শিকার তিনি। রক্তচাপও কম। পেটের যন্ত্রণার জন্য আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতে বলা হয়। তার আগে ব্যথা কমানোর ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে পেটে ব্যথার অতি সাধারণ ওষুধটুকুও মেলেনি। আলট্রাসোনোগ্রাফির আগের দিন নিয়ম মাফিক যে ওষুধ খেতে হয়, তা-ও মেলেনি সেখানে। আলট্রাসোনোগ্রাফির পরে চিকিৎসকেরা দেখেন, মিনুর জরায়ুতে একটি বড় সিস্ট রয়েছে। রক্তাল্পতার কথা মাথায় রেখে অস্ত্রোপচার না করে তাঁকে কিছু ওষুধ লিখে দেন হাসপাতালের চিকিৎসক। এ বারেও সেই প্রেসক্রিপশনের অধিকাংশ ওষুধ পাওয়া যায়নি হাসপতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে। ফলে বাইরে থেকে বেশি দামে অধিকাংশ ওষুধ কিনেছেন ওই তরুণী।

স্ত্রীরোগ বিভাগে সাধারণ কিছু ওষুধও যদি হাসপাতালে না মেলে, তবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কোথায় মিলবে? প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘সরকারি দাবির অন্তঃসারশূন্যতা এতেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলেও নীচের তলায় যাঁদের হাতে প্রয়োগের ভার, তাঁদের টনক নড়ছে না।’’

প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘প্রতি দিন বহু মানুষ চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা অনুরোধ নিয়ে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেই জানতে পারি, আসল পরিস্থিতিটা ঠিক কী। যা ন্যায্য ভাবেই পাওয়ার কথা, সেটাই পাচ্ছেন না অধিকাংশ মানুষ।’’ একই কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইঞাও। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ ওষুধও তো পাওয়া যায় না। সেখানে ক্যানসার, হার্টের ওষুধ ফ্রি হবে? গোড়ার গলদগুলোই তো ঠিক হচ্ছে না। আবেগের বশে ভুল প্রতিশ্রুতি দিলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি হয়রানির শিকার হবেন।’’

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘সমস্ত হাসপাতালের সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে ওষুধের বিষয়টায় তাঁরা নিজেরা নজরদারি করেন। শুধুমাত্র স্টোরকিপারের ভরসায় না থেকে নিজেদের দেখতে হবে, কোথায় কী ধরনের ওষুধ প্রয়োজন। টাকার জন্য কোনও কিছু আটকাবে না।’’ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা জানান, শুধু সুপার নন, চিকিৎসকদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাঁরা ফার্মেসিতে মজুত রয়েছে এমন ওষুধই প্রেসক্রাইব করেন। ‘‘এর অন্যথা হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,’’ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন