অসুস্থ শিশু কোলে উদ্বিগ্ন মা। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
শয্যা সাকুল্যে ১৮০। কিন্তু ভর্তি ৪২৪ জন রোগী। একই শয্যায় একাধিক রোগী তো বটেই, এমনকী উপচে পড়েছে মেঝেও। শুক্রবার এটাই ছিল বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালের ডায়েরিয়া ওয়ার্ডের ছবি।
পেটের রোগ নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকা, এমনকী জেলা থেকেও রোগীরা ভর্তি হয়েছেন এই হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ অসুখটিকে ডায়েরিয়া বলে দাবি করলেও চিকিৎসকদের একটি বড় অংশই জানাচ্ছেন, অধিকাংশ রোগীর মলের সঙ্গে রক্তও বেরোচ্ছে। তাই একে ডায়েরিয়া না বলে আন্ত্রিক বলাই শ্রেয়।
রবিবার থেকে শহরে জাঁকিয়ে বসেছে এই রোগ। অথচ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য ভবনে এর প্রকোপ সম্পর্কে কোনও খবরই ছিল না। দুপুরে হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য হাসপাতালের কর্তাদের বলেন, ‘‘গত কয়েকদিন ধরে আন্ত্রিক হচ্ছে। এত রোগী ভর্তি হয়েছেন। অথচ স্বাস্থ্য ভবন জানতেই পারল না। সংবাদমাধ্যমের কাছে আমাদের এটা জানতে হচ্ছে। কেন আপনারা স্বাস্থ্য ভবনকে আগেভাগে জানালেন না?’’ হাসপাতাল কর্তারা অবশ্য মন্ত্রীর প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
শুধু আই ডি নয়, শহরের অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালেও অনর্গল বমি ও পেটের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন অনেকেই। শুক্রবার সকালে বিধাননগর পুরনিগম এলাকার রবীন্দ্রপল্লির বাসিন্দা দেবজিৎ কর্মকার নামে একটি দেড় বছরের শিশু আন্ত্রিকে মারা গিয়েছে বলে নিগম সূত্রে খবর।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বৃষ্টির জমা জল নেমে যাওয়ার পরেই এই জলবাহিত রোগ ছড়াতে শুরু করেছে। দূষিত জল, খাবার এবং পরিচ্ছন্নতার অভাবেই এর বাড়বাড়ন্ত। খুব সাবধান না থাকলে এ প্রকোপ ঠেকানো মুশকিল। এ দিকে হাসপাতাল সূত্রে খবর, তিলজলা, তপসিয়া, পার্ক সার্কাস, বেলেঘাটা, নারকেলডাঙা, এন্টালি, বালিগঞ্জ, ট্যাংরা, দমদম ও মধ্যমগ্রাম, বিধাননগর, বেনিয়াপুকুর, সোনারপুর, গড়িয়া এলাকা থেকে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন। চিকিৎসকদের একাংশ আবার
একে কলেরার প্রকোপ বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও আই ডি-র অধ্যক্ষ উচ্ছ্বল ভদ্রের দাবি, ‘‘এটি বর্ষার ডায়েরিয়া। তার বেশি কিছু নয়।’’
রবিবার থেকেই বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে আন্ত্রিক রোগীর ভিড় শুরু হয়। হাসপাতালের অধ্যক্ষের দাবি, ডাক্তার-নার্স, পর্যাপ্ত ওষুধ এবং স্যালাইন নিয়ে তাঁরা এই রোগ মোকাবিলায় সব রকম ভাবে প্রস্তুত। রোগী যেমন ভর্তি হচ্ছেন, তেমনি সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে যাচ্ছেন। তাই দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। যদিও স্বাস্থ্যকর্তারা তাঁর এই দাবির উপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারেননি। কলকাতার চারটি মেডিক্যাল কলেজ (কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এনআরএস, আরজিকর এবং এসএসকেএম) থেকে ডাক্তার এবং নার্সের দল গঠন করে দফায় দফায় আই ডি-তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আই ডি-তে শয্যা না মেলায় শুক্রবার প্রায় একশো জন মা তাঁদের রুগ্ণ বাচ্চাকে নিয়ে মেঝেতেই বসেছিলেন। দমদমের বাসিন্দা দু’বছরের শুভকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন মা সোমা মান্না। মন্ত্রীকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘দিদি কিছু একটা করুন। দিনরাত কোলে নিয়ে বসে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’’এই দৃশ্য দেখে মন্ত্রী হাসপাতালের কর্তাদের বলেন, ‘‘এঁদের জন্য এখনই কোনও ব্যবস্থা করুন।’’
এর পরেই খুলে দেওয়া হয় অন্য একটি ওয়ার্ড। তার পরেও অবশ্য সমস্যা মেটেনি। বৃহস্পতিবার মেয়ে আয়েশা পারভিনকে (১৫) ভর্তি করেছেন তপসিয়ার বাসিন্দা মহম্মদ ইয়াসিন। তাঁর কথায়, ‘‘একই শয্যায় তিন জনকে রাখা হয়েছে। সকলেই খুব কষ্ট পাচ্ছে।’’
শহর জুড়ে আন্ত্রিকের এই বাড়বাড়ন্তে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্কও। এই রোগের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন বয়স্ক ও শিশুরা। ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ জানান, তাঁদের হাসপাতালে আন্ত্রিকের রোগী ছেয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত শয্যার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। প্রাইভেট চেম্বারেও যত রোগী আসছেন, তার অন্তত ৮০ শতাংশ আন্ত্রিকে আক্রান্ত। কেন এমন বাড়াবাড়ি? তিনি বলেন, ‘‘কেন হবে না? রাস্তায় জল জমছে। তার জেরে ট্যাঙ্কের জল, পুরসভার পাইপের জল দূষিত হচ্ছে। এমনকী দূষিত হয়ে পড়ছে বাড়ির রান্নাঘরও। এ ছাড়া, এত কিছুর পরেও রাস্তার খাবার খাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। ফলে পেটের অসুখ তো ছড়াবেই।’’
একই কথা বলেছেন গ্যাস্ট্রোএন্টোরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীও। তাঁর কথায়, ‘‘বৃষ্টির জমা জল যেই নামতে শুরু করেছে, অমনি এই সমস্যা মাথা চাড়া দিয়েছে। পানীয় জলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। না হলে বিপদ ঠেকানো যাবে না।’’