Art exhibition

গ্যালারির বাইরেও শিল্প আছে, চেনা শহরে আছেন অন্য রকম শিল্পীরাও! তাঁদের কাজ তুলে ধরছে ‘প্রত্যয়’

মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠে মূল স্রোতে মিলতে পারার আগে বেশ খানিকটা সময় লাগে। ‘প্রত্যয়’-এর বাসিন্দারা এখন সেই চষ্টায় মগ্ন। সেখানেই শিল্পচর্চাও করছেন। তাঁদের হাতে তৈরি জিনিস নিয়েই শুরু হচ্ছে প্রদর্শনী।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:২৭
Share:

ছক ভেঙেই শিল্পে হাত পাকিয়েছেন প্রান্তিক শিল্পীরা। ছবি : সংগৃহীত।

সামাজিক তা-ই, যা চেনা ছকের মধ্যে পড়ে। দুইয়ের সঙ্গে দুই জুড়ে যাঁরা শুধু চার লিখতে পারেন, তাঁরাই সমাজের অন্তর্গত হওয়ার শংসাপত্র পান। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা চেনা অঙ্কের উত্তরে চারের জায়গায় পাঁচ বলবেন। কারণ, জীবনটাকে তাঁরা অন্য ভাবে দেখেন। হিসাবও তাঁর অন্য। আরও এক রকমের মানুষজন হন, যাঁদের জীবনটাই সেই চেনা হিসাবের বাইরে। মাঝেমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তাঁরা। আর এসেই বাকিদের অস্বস্তিতে ফেলেন। কারণ, বাকি সব হিসাব গুলিয়ে যায় যে!

Advertisement

রবিবার তেমনই এক হিসাব গোলানোর দিন। বন্ডেল রোডের ‘প্রত্যয়’-এ শুরু হয়েছে এক শিল্প প্রদর্শনী। মূলত সেরামিকের কাজ, ব্লক প্রিন্টের কাজ দেখা যাবে সেখানে। কিন্তু সেটিই যে একমাত্র কথা, তা নয়! শিল্পকর্ম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই জরুরি সেই শিল্পীদের চিনে নেওয়া। কারণ, শিল্পী বললে ঠিক যেমন ধারণা মানুষের মনে ভেসে ওঠে, তাঁরা ঠিক সেই ছকে পড়েন না। শিল্পে যেমন ছক ভাঙা আছে, তেমনই আছে শিল্পী হয়ে ওঠার পথেও। এ বারের শিল্পীরা তেমনই। এক কথায় প্রান্তিক তাঁরা। ছক ভেঙেই শিল্পে হাত পাকানো।

‘প্রত্যয়’-এর কাজ হয় মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের উপদেশ মতো। ছবি: সংগৃহীত।

যে কোনও সমাজে প্রান্তিকের ভার বেশি, মূলস্রোতের থেকে। তবু তাঁদের কম দেখতে পাওয়া যায়। দেখেও না দেখা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক ভাবে অসুস্থরা সেই দলে পড়েন। তাঁদের সমাজের অংশ বলে ধরার অভ্যাস হয়নি এখনও। তাঁরা সেরে উঠলেও তাই সমাজ বুঝতে পারে না, কী ভাবে গ্রহণ করবে বা করবে না। তেমনই আর একটি গোষ্ঠী হল, যৌনতার নিরীখে প্রান্তিকরা। আছেন তাঁরা সর্বত্র। দিব্যি সব কাজ করছেন। সকলে দেখছেন। কিন্তু কেউ তাঁদের চিনবেন না, কাছে টানবেন না— তা একরকম ঠিক করে নিয়েছেন। সেই দুই ধরনের মানুষ এ বার কাছাকাছি। হাত মিলিয়েছেন শিল্পের মাধ্যমে।

Advertisement

ক্যুয়র অর্থাৎ অদ্ভুত। যৌনতার নিরিখে ক্যুয়র বা অদ্ভুত বলে যাঁরা পরিচিত, গোটা বিশ্বের মতো কলকাতা শহরেও তেমন ব্যক্তি কম নেই। তাঁদের কেউ কেউ আবার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। শিল্পই তাঁদের পরিচয়। শিল্পী অনিন্দ্য হাজরা, কল্লোল দত্তরা হাত মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের নিয়ে কাজ করতে। এক দিকে মানসিক রোগ থেকে বেরিয়ে আসা আবাসিকেরা, অন্য দিকে ক্যুয়র শিল্পীরা, নিজেদের প্রান্তিক অবস্থানের অভিজ্ঞতাকে শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরছেন। গত এক মাস ধরে চলেছে প্রস্তুতি। কেউ সেরামিকের কাজ শেখাচ্ছেন, কেউ শিখছেন। নতুন নতুন জিনিস বানাচ্ছেন। কেউ বা কাপড়ের উপরে ব্লক প্রিন্ট করায় মন দিচ্ছেন। অনিন্দ্য বলেন, ‘‘আমাদের শহরটার মধ্যে অনেকগুলো শহর বাস করে। একটা শহরের মানুষ বাকি সব শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে বিশেষ তো কথা বলেন না। জানেন না, অন্যরা কী ভাবে বসবাস করেন, কী ভাবেন। আমাদের এই প্রদর্শনীর সব জিনিসপত্র হয়তো সেই কথোপকথনটা শুরু করবে। এমনই আশা!’’ শিল্পী কল্লোল দত্তের সুরও এক। পরিচিত গ্যালারির বাইরেও শিল্পের একটি বড় জগৎ আছে। সমাজ যাকে শিল্প বলে তার বাইরেও শিল্পভাবনা আছে। ‘প্রত্যয়’-এর মতো একটি বাড়িতে যখন একটি প্রদর্শনী হয়, তখন সেই জায়গাটিতে নাড়া পড়ে, মনে করেন কল্লোল। সেই রাজনীতি আগামীতে সমাজকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে বলেই মনে করেন তিনি।

গত এক মাস ধরে চলেছে প্রস্তুতি। কেউ সেরামিকের কাজ শেখাচ্ছেন, কেউ শিখছেন। ছবি: সংগৃহীত।

‘প্রত্যয়’-এর কাজ হয় মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের উপদেশ মতো। এ বারের প্রদর্শনীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘স্বাভাবিকতা, মানে, ‘এমনটা হলে ঠিকঠাক’— এটা আসলে একটা সংখ্যাগুরুর বয়ান। সংখ্যালঘুর যে আলাদা একটা স্বাভাবিকতার ধারণা থাকতে পারে, সেটাকে অস্বীকার করা দিয়েই সংখ্যাগুরুর এই বয়ান প্রতিষ্ঠা পায়। আমরা প্রান্তিকতা নিয়ে কাজ করি। ফলে অন্যতর বয়ানগুলো আমাদের খুঁজতে হয়, বুঝতে হয়। এইটাও সে রকম একটা বোঝাপড়া তৈরির চেষ্টা। সে চেষ্টায় সংখ্যাগুরুর একটা অংশও অন্তত এই বুঝতে চাওয়ার সংবেদনশীলতাটুকু দেখাবেন, এটা একটা প্রত্যাশা। ‘অদ্ভূত’ আর ‘ক্ষ্যাপা’ এই দু’রকমের মানুষ একসঙ্গে এসে, তাঁদের স্বাভাবিকতাকে বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গীতে ধরেছেন। ওই প্রকাশভঙ্গীটাই তো শিল্প। এই ভঙ্গিমাগুলো কিছু প্রশ্ন তৈরি করবে, কিছু উত্তর পেতে সাহায্য করবে, কিছু অন্য রকমকে বোঝার চেষ্টা তৈরি করবে— আর তার ফলে একটা কথোপকথনের ক্ষেত্র তৈরি হবে। এই প্রত্যাশায় আমরা এই কর্মশালা এবং এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি। এ বার সংখ্যাগুরুর ‘স্বাভাবিকতা’ কতটা সংবেদনশীলতা কতটা সহনশীলতা দেখাতে পারে, সেটুকু তো সময় বলবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement