Same Gender Marriage

দুই কন্যার রূপকথা! কী ভাবে সম্ভব হল রিয়া-রাখির ভালবাসার স্বীকৃতি? বিয়েই কি সমপ্রেমের শেষ কথা?

এমন এক রূপকথা, যেখানে রাজপুত্তুর নেই, রয়েছেন দুই রাজকন্যা। তাঁদের ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ জীবনের জন্য পথের কাঁটাগুলো ফুলে ফুলে ঢেকে দিচ্ছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, এমন বিয়ে মোবাইলে দেখেছেন, কিন্তু সামনে থেকে এই প্রথম।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৯
Share:

প্রত্যন্ত গ্রামে দুই নারীর বিবাহ কোনও বাধা হয়েই দাঁড়ায়নি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বিনা মেঘে কী ভাবে রামধনু ফুটে ওঠে, তা তাঁরা জানেন বলে মনে হয় না। ‘প্রাইড প্যারেড’ বা ‘প্রাইড মান্থ’ সম্পর্কেও সম্ভবত সম্যক ধারণা তাঁদের নেই। তবু দক্ষিণ ২৪ পরগনার রামেশ্বরপুর গাববেড়িয়া গ্রামটি এই মুহূর্তে অনেকের নজরেই অ-সাধারণ। এই গ্রামের মানুষজন সম্প্রতি দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা রাখী নস্কর ও রিয়া সর্দার নামের দুই নারীর। এ দেশে সমলিঙ্গের বিবাহ আইনি স্বীকৃতি পাবে কি পাবে না, এই নিয়ে লিঙ্গসমতা ও প্রান্তিক যৌন পরিচিতির মানুষদের নিয়ে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও সংগঠনের এখনও সংশয় কাটেনি। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামের মন্দিরে, প্রায় বিনা বাধায় দুই কন্যার চার হাত এক করার এই ঘটনাটি এলাকার বাসিন্দাদেরও সারা দেশের থেকে খানিক ‘আলাদা’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে তাঁদের ভূমিকা।

Advertisement

রিয়া এবং রাখী, দু’জনেই পেশাগত ভাবে নৃত্যশিল্পী। তাঁরা নৃত্য পরিবেশনের ডাক পান সাধারণত পাশের রাজ্য বিহার থেকে। বিয়ের আসরে নৃত্য পরিবেশন করতে তাঁদের মঝেমধ্যেই দূর-দূরান্তে পাড়ি দিতে হয়। এমন যাপনের মধ্যে খানিক ঝুঁকি, খানিক অনিশ্চয়তা রয়েছেই। তার উপরে এই সমলিঙ্গের সম্পর্ক। কতখানি জটিলতা পার হতে হয়েছে দু’জনকে? প্রশ্ন করায় রিয়া ফিরে গেলেন তাঁদের সম্পর্কের শুরুর দিনগুলিতে।

তাঁদের আলাপ ফোনে। মাধ্যম এক বান্ধবী। তাঁর কাছ থেকেই রিয়ার ফোন নম্বর নিয়ে রাখী জানিয়েছিলেন, “ভালবাসি”। বিভিন্ন জায়গায় এর পর দেখা হতে শুরু করে। দু’জনে একসঙ্গে নাচের অনুষ্ঠান করতেও যান। এ ভাবেই প্রেম ঘনায়। দিন যায়। কিন্তু এই সম্পর্কের পরিণতি কী? রিয়া জানালেন, প্রথমে বিহারের এক মন্দিরে তাঁরা বিয়ে করেন। ফিরে এসে একসঙ্গে বাসও করতে শুরু করেন। গোড়ার দিকে রাখীর বাড়ির দিক থেকে তেমন সমস্যা ছিল না। সাত মাস রিয়া থেকেছেন রাখীর বাড়িতে। সেখান থেকেই নাচের অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু ক্রমে দেখা যায়, রাখীর মায়ের ব্যবহার কঠোর হয়ে উঠছে। রাখীদের বাড়ি অন্য গ্রামে। জয়নগর জামতলা। রিয়ার অভিযোগ, সেখানে তাঁদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হতে কেউ মেনে নেননি। এমনকি, গ্রামের ক্ষমতাবান কেউ রিয়ার গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন।

Advertisement

এর আগে বিহারের এক মন্দিরে বিয়ে করেছিলেন যুগল। ছবি: সংগৃহীত।

এর পরেই রিয়া বাড়ি ফিরে আসেন। রামেশ্বরপুরের মানুষ তাঁদের প্রতি সহৃদয়ই ছিলেন। বিহারে মন্দিরে বিয়ের কথা রিয়া বাড়িতে জানালে, তাঁর বাড়ির লোকেরা মেনে নেন। তার পরের ঘটনা ইতিমধ্যেই সংবাদের পাতায়। স্থানীয় এক ক্লাবের সহায়তায় এক মন্দিরে আবার বিয়ের আয়োজন। চার হাত এক করে গ্রামের মানুষ ভালবাসাকে উদ্‌যাপন করেন।

গল্প যেন রূপকথার। কিন্তু এমন এক রূপকথা যেখানে রাজপুত্তুর নেই, রয়েছেন দুই রাজকন্যে। তাঁদের ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ জীবনের জন্য পথের কাঁটাগুলো ফুলে ফুলে ঢেকে দিচ্ছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ, যাঁদের বক্তব্য, এমন বিয়ে মোবাইলে দেখেছেন, কিন্তু সামনে থেকে এই প্রথম।

কিন্তু কী ভাবে সম্ভব হল এই বিয়ে? উত্তর কি সেই ‘মোবাইল’ শব্দটিতেই নিহিত? হাতের মুঠোয় যখন দুনিয়া, তখন ‘প্রাইড’ শব্দটি থেকে বহু দূরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই গ্রামটিতে রামধনু ছাতার মতো নিজেকে মেলে ধরল! শহরের পথে যে আত্মপরিচয়কে ব্যক্ত করতে স্লোগানে, ব্যানারে, পতাকায় ভূষিত হয়ে পথে নামতে হয় প্রান্তিক যৌন পরিচিতির মানুষদের, সেখানে এক প্রত্যন্ত গ্রাম শুধু মোবাইল থেকে জেনে গেল, এমন বিয়েও ‘অ-স্বাভাবিক’ নয়! রিয়া জানালেন, এমন সম্পর্কে তাঁদের জানাশোনা ৫-৭ জন জুটি রয়েছেন। বিয়ে না করলেও তাঁরা একত্রবাস করছেন এবং ভালই আছেন।

এই সময়ের এক বামপন্থী রাজনৈতিক নেত্রী রিয়া-রাখীর কাহিনিকে ছবি সমেত তাঁর সমাজমাধ্যমের পাতায় পোস্ট করেছেন। বহু লাইক আর শেয়ার হয়েছে সেই পোস্ট। মন্তব্য-বাক্সে দুই কন্যেকে সাবাসি দিয়েছেন বহু জনে। তার মাধ্যমে সমলিঙ্গে বিয়ের খবরটি দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেও যে বেসুর শোনা যায়নি, তা নয়। বেশ কিছু কটুকাটব্য সেখানে রয়েছে। ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’-ই। কিন্তু তার পর? রিয়া জানালেন, তার আর ‘পর’ নেই। নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো আর নতুন সংসারকে গুছিয়ে তোলাই এখন লক্ষ্য দু’জনের।

‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠানটিই এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার সিলমোহর। ছবি: সংগৃহীত।

সংবাদের পরের অংশ এই ছায়াছবির পর। প্রসঙ্গটি রাখা হল কলকাতার ‘সাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’-র সহ প্রতিষ্ঠাতা, লিঙ্গসমতা ও প্রান্তিক যৌন পরিচিতির মানুষদের অধিকার নিয়ে কর্মরত মীনাক্ষী সান্যালের কাছে। প্রশ্ন ছিল, শহর থেকে দূরে কী ভাবে সম্ভব হল এ হেন গণচৈতন্যের, যেখানে দু’জন সমলিঙ্গের মানুষের বিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন গ্রামবাসীরা? দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মীনাক্ষী জানালেন, এমন ক্ষেত্রে শহর বা গ্রাম, অর্থাৎ এক কথায় ভৌগোলিক অবস্থান কোনও বড় বিষয় নয়। শহর মানেই যে সেখানকার মানুষ মুক্তমনা হবেন আর গ্রামের ক্ষেত্রে উল্টোটা, এমন ভাবাও একটা নির্মাণ মাত্র। ক্ষমতার নির্মাণ। মীনাক্ষীর কথায়, “আসল ব্যাপার হল, কী ভাবে আপনি ভালবাসাকে দেখছেন। শহরবাসী উচ্চবর্গের, তথাকথিত উচ্চবর্ণের মধ্যে কি নিজস্ব সামাজিক অবস্থানগত অহমিকাবোধ নেই? সেই অহমিকা কি কার্যত একটা সরু, অন্ধকার গলির ভিতরে ঠেলে নিয়ে যায় না মানসিকতাকে?” গ্রাম মানেই ‘অজ্ঞতা’— এমন ধারণা মনের মধ্যে পুষে রাখাটাই মস্ত বড় ভুল। রিয়ার গ্রামের মানুষেরা মীনাক্ষীর ভাষায়, “অনেক ঊর্ধ্বে গিয়ে ভেবেছেন।” দু’জন মানুষের ভালবাসার মর্মকে তাঁরা মর্যাদা দিয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি ছিল ‘বিয়ে’ নিয়ে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ছক ভাঙতে চাওয়া দু’জন মানুষ কেন নত হবেন ‘বিয়ে’ নামে আর একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। রিয়ার কথা থেকে বার বার উঠে এসেছে এমন আভাস, যা থেকে বোঝা যায়, ‘বিয়ে’ ব্যাপারটা তাঁদের কাছে অনেক কিছু। তা আচার, হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির অনেকটাই উপরে থাকা একটা প্রতিশ্রুতি। নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। মীনাক্ষীর মতে, বিয়ে নেহাতই একটা সামাজিক সিলমোহর। রিয়া-রাখী এটুকু ভেবেছেন যে, বিয়ে নামের ঘটনাটি ঘটে গেলে তাঁদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। এখানে আইন বড় কথা বলে না, বলে সমাজ। পরে যেন কেউ জোর করে তাঁদের কাউকে অন্য কারও সঙ্গে (অবশ্যই পুরুষের) বিয়ে দিতে না পারেন, সেই নিশ্চয়তাটুকু এই বিয়ে দিয়েছে। এর জন্য গ্রামের মানুষকে অভিনন্দন জানালেন মীনাক্ষী। এমনিতেও তো তার বেশি কিছু নেই। কারণ, সমলিঙ্গের বিবাহ আইনি স্বীকৃতি এখনও পায়নি এ দেশে। কবে পাবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই।

বাকি থাকে গণমাধ্যম। মিডিয়া। অবশ্যই ‘মোবাইলে দেখা এমন বিয়ে’-র উদাহরণ তাঁদের সামনে ছিল বলেই গ্রামের মানুষ এই উদারতাটুকু দেখাতে পিছপা হননি। মীনাক্ষীর মতে, গ্রামবাসীরা যে নতুন নজির সৃষ্টি করলেন, তার মধ্যে কোথাও যেন ভারতের নারী ক্রিকেট দলের বিশ্বজয়ের স্পিরিটটি লুকিয়ে আছে। যে কোনও জয়কে ‘জয়’ হিসেবে যে নিক্তিটি নির্ধারণ করে দেয়, তা অবশ্যই জনমতের স্বীকৃতি। স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের হর্ষোল্লাস সে দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামটির মন্দিরে শোনা যায়নি। কিন্তু উলুধ্বনি বা জাগ্রত অগ্নির সামনে মালাবদলরতা দুই মানবীর ব্যবধানহীনতার অন্তরালে কোথাও সেই হর্ষ ছিলই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement