Shakespear in Kolkata

সমাজমাধ্যমই যখন সত্যান্বেষী! খোঁজ মিলল ‘কলকাতার শেক্সপিয়র’দের বর্তমান প্রজন্মের

আজ থেকে তিন দশক আগেও খোঁজ পাওয়া যেত না কলকাতার শেক্সপিয়রদের, জানা যেত না এক সময়ে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক বিশেষ পরিবারের বর্তমান মানুষটিকে।

Advertisement

দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১১
Share:

কলকাতাতেও ছিলেন শেক্সপিয়রেরা। তাঁরা অবশ্যই অ্যাভনের কবির বংশধর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পৃথিবীতে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার আছে, যাদের নামই যথেষ্ট। আর কোনও পরিচিতির প্রয়োজন পড়ে না। শেক্সপিয়র এমনই একটি নাম। কিন্তু ‘কলকাতার শেক্সপিয়র’? এ তথ্যটি কেমন যেন হেঁয়ালি মনে হচ্ছে ওই ‘এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে’ গোছের! কিন্তু হ্যাঁ, ছিলেন এবং আছেন কলকাতার শেক্সপিয়রেরা, বহাল তবিয়তে। এবং তাঁরা ‘বার্ড অফ অ্যাভন’-এর জ্ঞাতি এবং আত্মীয়। কথাও দিয়েছেন আসবেন কলকাতাকে দেখতে অতি আগ্রহের সঙ্গে, অদূর ভবিষ্যতেই।

Advertisement

ঘটনা একটু খোলসা করে বলা যাক। শীতের সময়। মিঠে রোদ্দুর, গরম কফি বা চা বা আর কিছু, এবং রুচিমাফিক ফিশ ফ্রাই অথবা কিমার চপ, নিদেন পক্ষে চানাচুর আর বাঙালির অফুরান আড্ডা। চালাও পানসি বেলগ্রাভিয়া। ওই উনিশ শতকের নব্যবাবুরা যা বলতেন আর কি! তবে আমরা যাব ইংল্যান্ড, রানির… থুড়ি রাজার দেশে। পেনেটির কাছের বেলগাছিয়া বা বেলঘরিয়া নয়।

তবে আমাদের এই যাত্রা বিমান বা নিদেন পক্ষে জাহাজে চেপেও নয়। এই অভিযান একান্ত ভাবেই অন্তর্জাল এবং সমাজমাধ্যম নির্ভর। কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই যেমন আবার ফিরে আসতে পারে, তেমনই কলকাতার শেক্সপিয়রেরা কলকাতায় কবরস্থ হলেও বা এ শহর ছেড়ে চলে গেলেও বিশ্বসংসার থেকে যে তাঁদের চিহ্ন লুপ্ত হয়ে যায়নি, তা মালুম হল সমাজমাধ্যমের সূত্রেই। হলফ করেই বলতে পারি, আজ থেকে তিন দশক আগেও এ ভাবে খোঁজ পাওয়া যেত না কলকাতার শেক্সপিয়রদের, জানা যেত না এক সময়ে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক বিশেষ পরিবারের বর্তমান মানুষটিকে। শুধু তা-ই নয়, সমাজমাধ্যম আর ই-বাণিজ্যের সৌজন্য ছাড়া তাঁরও জানা হত না তাঁরই পারিবারিক ইতিহাসের এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়। রহস্য রেখে আসল কথায় আসা যাক।

Advertisement

কলকাতার শেক্সপিয়র বংশের বর্তমান প্রতিনিধি নাইজেল শেক্সপিয়র।

শেক্সপিয়র পরিবারের একটি শাখা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কলকাতা তথা বাংলা ও ভারতে চলে এসেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৭৭০ সালে এবং কোম্পানির প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল, এ খবর আমরা, বাঙালিরা অনেকেই রাখি না। আমাদের গল্প সেই ‘কলকাতার শেক্সপিয়র’ পরিবারকে নিয়েই। আর বিশেষ করে এই পরিবারের এক বর্তমান সদস্য নাইজেল শেক্সপিয়রকে নিয়ে। নাইজেল বর্তমানে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের বাসিন্দা পেশায় ফ্রিল্যান্স লেখক ও কলামনিস্ট (রক্তের ধাত কোথায় যাবে)। ইংল্যান্ডেও, তাঁর কথামতো, ছোটখাটো একটি বাসস্থান আছে। ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় ২০২৪-এর ২৬ জুলাই। আমার সম্প্রতি বই ‘হ্যারি হব্স অফ কলকাতা অ্যান্ড আদার ফরগটন লাইভস’-এর সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার তখন সবে শুরু হয়েছে। ঠিক সেই সময়ে এক সোশ্যাল মিডিয়া মেসেজ সিস্টেমের মাধ্যমে নাইজেল নিজের পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার এক পুরনো প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি ১৭৭০-এ কলকাতায় আগত জন শেক্সপিয়রের বংশধর এবং প্রমাণস্বরূপ পারিবারিক কিছু তথ্যও পেশ করেন।

আজকের সাইবার ক্রাইমের যুগে এ জাতীয় মেসেজ বা ইমেলকে সহজে বিশ্বাস করা মুশকিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, ওঁকে আমার বইয়ের আমাজ়ন লিঙ্ক পাঠিয়ে দিই। গল্পের এখানেই ইতি হতে পারত। কিন্তু তা হল না। সিনেমার জটিল চিত্রনাট্যের মতো এই সোশ্যাল মিডিয়ার যোগাযোগ বন্ধ হল না। নাইজেল জানালেন যে, আমার বইয়ে কলকাতার শেক্সপিয়রদের গল্পটি তিনি পড়বেন ও পরবর্তীকালে যোগাযোগ করবেন।

কবি-নাট্যকার উইলিয়ম শেক্সপিয়রের পিতামহ রিচার্ড এবং পিতামহী অ্যাবিগেলের পাঁচ সন্তান— হেনরিয়ে, অ্যানা, জন, টমাস এবং ম্যাথ্যু। এঁদের মধ্যে জন শেক্সপিয়র এবং তাঁর স্ত্রী মেরিই হলেন আমাদের একান্ত পরিচিত ‘বার্ড অফ অ্যাভন’ উইলিয়ম শেক্সপিয়রের বাবা-মা। জনের ছোট ভাই টমাস, মানে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের আপন ন’কাকার ছেলে (আর এক জন) এবং তাঁর বংশধরেরা পরিচিত ছিলেন ‘শ্যাডওয়েল শেক্সপিয়র’ নামে। এঁরা লন্ডনের শ্যাডওয়েলের বাসিন্দা ছিলেন। দড়ি তৈরির ব্যবসায় এঁরা বেশ প্রতিষ্ঠা পান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের জন্য দড়ি এই শ্যাডওয়েল শেক্সপিয়র পরিবার জোগান দিত। এঁরা এঁদের পদবির শেষ প্রান্তে অবস্থানরত ‘ই’ অক্ষরটি বর্জন করেন এবং এঁদের পদবি ‘শেক্সপিয়র’ হলেও উইলিয়ম শেক্সপিয়রের বানানের সঙ্গে পার্থক্য তৈরি হয়।

শেক্সপিয়র পরিবারের প্রায় প্রতিটি প্রজন্মের পুরুষদের নামকরণের ব্যাপারে এক অদ্ভুত রক্ষণশীলতা দেখা যায়। জন, ম্যাথ্যু, উইলিয়ম আর টমাস— এই নাম ক’টি ঘুরেফিরে আসে প্রায় প্রতিটি প্রজন্মেই। নাট্যকার শেক্সপিয়রের ন’কাকার ছেলে জনের নাতির নাতি জন শেক্সপিয়র (১৭৪৯-১৮২৫) ছিলেন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের একান্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁর সূত্র ধরেই ভারতে শেক্সপিয়র-বংশধরদের আগমন ঘটে। এই জন শেক্সপিয়র পলাশির যুদ্ধের এক দশক পরে বাংলায় কোম্পানির ‘রাইটার’ হিসাবে কাজ করতে আসেন ও ১৭৭৮-এ, মাত্ৰ ২৯ বছর বয়সে, ঢাকায় কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৭৮০-তে বিপুল ধনসম্পদ সঞ্চয় করে তিনি লন্ডন ফিরে যান।

ব্রিটিশ লাইব্রেরির ‘আনটোল্ড লাইভস ব্লগ’-এ ইন্ডিয়া অফিস প্রাইভেট পেপার্স-এর কিউরেটর শিয়াও ওয়েই বন্ড লিখেছেন— “ফারসি ও আরবি সাহিত্যের খ্যাতনামা শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক ওমর পাউন্ড (১৯২৬-২০১০), যিনি মার্কিন কবি এজ়রা পাউন্ড ও তাঁর ইংরেজ পত্নী ডরোথি শেক্সপিয়রের একমাত্র পুত্র, তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর যাবতীয় পারিবারিক পুথিপত্র, পাণ্ডুলিপি, চিঠি ইত্যাদি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দান করে গিয়েছেন।” প্রসঙ্গত, এজ়রা এবং ডরোথির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ডরোথির মা অলিভিয়া শেক্সপিয়রের (১৮৬৩-১৯৩৮) সালোঁতে। এই অলিভিয়া আবার ছিলেন কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের এক সময়কার প্রেমিকা। তিনি নিজেও উপন্যাস, নাটক লিখেছেন। সেই সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও অলিভিয়ার খ্যাতি ছিল। কেনসিংটনে তাঁর সালোঁতে এজ়রা পাউন্ড, টিএস এলিয়ট এবং জেমস জয়েসের মতো লেখকেরা নিয়মিত যেতেন। কিউরেটর বন্ড আরও লিখেছেন, “শেক্সপিয়র পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব ব্রিটিশ ভারতের সারস্বত ও সামরিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এঁদের মধ্যে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর লেখক সাহিত্যিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে, লখনউয়ের বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ জেনারেল স্যর জন লো, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিশিষ্ট সেনানায়ক কর্নেল রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়র উল্লেখযোগ্য। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নামের সঙ্গে যাতে কোনও বিভ্রান্তি না ঘটে, সেই কারণে ব্রিটিশ ভারতের শেক্সপিয়রেরা নিজেদের পদবির অন্তিমে থাকা ‘ই’ অক্ষরটি বাদ দেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, এঁদের অন্যতম পূর্বপুরুষ ছিলেন শ্যাডওয়েলের জন শেক্সপিয়র, যিনি কি না স্ট্র্যাটফোর্ডের কবির সঙ্গে রক্তের সম্পর্কযুক্ত।”

জন শেক্সপিয়রের ছেলে জন ট্যালবট শেক্সপিয়র (১৭৮৩-১৮২৫), উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে সিনিয়রের মেয়ে এমিলি থ্যাকারেকে (১৭৮০-১৮২৪ ) বিয়ে করেন। এমিলি আবার সাহিত্যিক থ্যাকারের পিসি। ১৮০৩ সালের মার্চ মাসে শেক্সপিয়র-থ্যাকারে পরিবাবারের এই বিয়ে হয় কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চে। সেই সময়ে জন ট্যালবট বীরভূমের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর। ট্যালবট ও এমিলির ন’টি সন্তান হয়। তাঁদের মধ্যে তিন পুত্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দেন (ঘটনাচক্রে তাঁদের এক জনের নাম ছিল উইলিয়াম মেকপিস। কিন্তু তিনি ছিলেন উইলিয়াম মেকপিস শেক্সপিয়র)।

এই দম্পতির আর এক ছেলে ছিলেন জর্জ ট্রেন্ট। তিনি সেনাবাহিনীতে বা সিভিল সার্ভিসে যাননি, কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে তিনি বিখ্যাত হন। তাঁকে ‘রলি পলি জর্জ’ বলে ডাকা হত। এমন নামকরণের পিছনে যে কারণ ছিল, তা এই— জর্জ ছিলেন বিপুলায়তন মানুষ, তাঁকে ‘পোলার বিয়ার’ বা ‘শ্বেত ভালুক’ বলে ডাকা হত। তার উপরে তাঁর হাঁটাচলাও ছিল মন্থর, ঢিলেঢালা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য টিয়ার্স অফ দ্য রাজাজ়: মিউটিনি, মানি অ্যান্ড ম্যারেজ ইন ইন্ডিয়া, ১৮০৫-১৯০৫’ গ্রন্থে ফার্ডিন্যান্ড মাউন্ট লিখেছেন, “উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়রের ধ্রুপদী রচনা ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর স্থূলকায়, অলস এবং অতিরিক্ত সাজগোজ-প্রিয় চরিত্র জো সেডলি আসলে জর্জ ট্রেন্ট শেক্সপিয়রের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা।” জর্জ-ট্রেন্ট কোনও দিন খুব একটা কাজকর্ম করেননি। সুন্দরবনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন কিছু দিনের জন্য। তিনি ১৮৪৪ সালে ৩৪ বছর বয়সে জেনেভায় আত্মহত্যা করেন।

জন ট্যালবট এবং এমিলির কন্যা অগস্টা তাঁর পিতামহ জন শেক্সপিয়রের বন্ধু রবার্ট লো-এর বংশধর স্যর জন লো-কে বিয়ে করেন। জন লো সেই সময়ে লখনউয়ের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট। আর সেই সময়েই লখনউয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের হাত থেকে অরাজকতার অজুহাতে অধিগ্রহণ করছে কোম্পানি। সেই দিন বদলের পালা এবং সেখানে জন লো-র উপস্থিতি ও ভূমিকার কথা বিস্তারিত লিখেছেন ফার্ডিন্যান্ড মাউন্ট তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে।

শেক্সপিয়র আর থ্যাকারে— দুই পরিবার কাছাকাছিই থাকত। কলকাতার আলিপুর রোডের দুই ভিলায় ছিল তাঁদের বাস। এমিলি আবার তাঁর আবাসে নিয়মিত পার্টি দিতেন, যেখানে সেই সময়কার কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রায় সব্বাই আমন্ত্রিত হতেন।

পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে জন ট্যালবট শেক্সপিয়রের স্মারক স্তম্ভ।

আলিপুরেই সাহিত্যিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়র জন্মান। তাঁর বাবা এমিলির ভাই রিচমন্ড থ্যাকারে এবং মা অ্যানি বেচার। রিচমন্ড ছিলেন ২৪ পরগনার কালেক্টর, অর্থা়ৎ এখন আমরা যাকে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলি। ১৮২৪ সালে এমিলি শেক্সপিয়র কলকাতাতেই কলেরায় মারা যান। তাঁর বয়স তখন ৪৪। সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটারিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্বামী জন ট্যালবট মারা যান ১৮২৫ সালে। তিনি মারা গিয়েছিলেন জাহাজে। তাঁকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। কিন্তু, এমিলির কবরের ঠিক পাশটিতে জনের একটা স্মারক স্থাপন করা হয়। আজও এই সমাধি ও স্মারক বিদ্যমান।

জন ট্যালবটের তৃতীয় ভাই হেনরি ডেভেনপোর্ট শেক্সপিয়র (১৭৮৬- ১৮৩৮) ‘কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার’ মেম্বার ছিলেন, আর ছিলেন কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এবং লটারি কমিটি, যা নাকি কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামোকে দিয়েছিল আধুনিকতার দিশা, তার সদ্যস্য। এ ছাড়া, হেনরি ডেভেনপোর্ট ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে একনিষ্ট সহযোগী। ভারতের সরকারি কাজকর্মে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চালু করার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন। কলকাতার মিশন চার্চে তাঁর কবর রয়েছে।

চলচ্চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক ১৯৭৫-এ উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে জুনিয়র লিখিত ১৮৪৪-এর উপন্যাস ‘দ্য মেমোয়ার্স অব ব্যারি লিন্ডন এস্কোয়ার’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়ে চারটি অস্কার জেতেন। মীরা নায়ার ২০০৪-এ থ্যাকারের ক্ল্যাসিক ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ চলচ্চিত্রায়িত করেন। এই কাহিনি ১৮৪৮-এ লিখিত। যাতে জর্জ ট্রেন্টের আধারে তিনি সৃষ্টি করেন জো সেডলির চরিত্র।

এমিলি ও জন ট্যালবটের কনিষ্ঠ পুত্র কর্নেল স্যর রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়রের নাম আবার অন্য এক কারণে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। এই ব্রিটিশ রাজপুরুষ ভোপালের নবাব পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সংযোগসেতু হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৮৫০-এর দশকে ভোপাল ইংরেজদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল। দক্ষিণের হায়দরাবাদি নিজামশাহির পরে ভোপালই ছিল বৃহত্তম রাজ্য। ওই সময়ে নবাব সিকান্দর বেগম তাঁর মেয়ে নবাব শাহ জাহান বেগমের বিরুদ্ধে ভোপাল রাজ্যের নবাবি পদের দাবিদার হন এবং ও নিজের জন্য ইংরেজদের সমর্থন দাবি করেন। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময়ে সিকান্দর বেগম ইংরেজদের সমর্থন করেছিলেন। তাঁর কারণেই ভোপালে তেমন ভাবে বিদ্রোহ ছড়াতে পারেনি। ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশ, ইস্তেহার বিলি ইত্যাদি তিনি কড়া ভাবে নিষিদ্ধ করেন। তাঁর নিজের গুপ্তচরদের তিনি স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসনকে সাহায্য করতে নির্দেশ দেন, ব্রিটিশ বিরোধী সেনাদের অনেককেই ব্রিটিশ পক্ষে ফিরিয়ে আনেন। ১৮৫৭-র ডিসেম্বরে বিদ্রোহী সিপাহিদের একটি দল তাঁর প্রাসাদ ঘেরাও করে তাঁর জীবন বিপন্নও করেছিল বলে জানা যায়। এর পিছনে আবার ভোপালের নবাব পরিবারের অন্য সদস্যদের মদত ছিল, এ কথাও অনেকে বলেন।

আসল ঘটনা এই যে, সিকান্দর বেগমের মা নবাব কুদসিয়া বেগম তাঁর নাতনি শাহ জাহান বেগমকে নবাব পদের অধিকার দিয়ে যান এবং নিজের মেয়ে সিকান্দরকে দিয়ে যান শুধু মাত্র তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। সিকান্দর বেগম এই ব্যাবস্থায় একেবারেই খুশি ছিলেন না। তাই ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সাহায্য করার বিনিময়ে তিনি নবাবির অধিকার দাবি করেন। ভোপাল রাজ্যের অভিজাতদের একাংশ কিন্তু এর বিরোধিতা করেন এবং বিদ্রোহী সিপাহিদের সিকান্দর বেগমের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে থাকেন। রাজ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। সিকান্দার বেগম কঠিন হাতে এই বিরোধিতা দমন করেন ও ইংরেজদের বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেন।

১৮৫৯ সালে স্যর রিচমন্ড ক্যাম্পবেল মা ও মেয়ে— সিকান্দর এবং শাহ জাহান বেগমের সঙ্গে এক বছর ধরে আলাপ- আলোচনা করে ভোপাল রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন ও নবাবি সমস্যার মীমাংসা করেন। ১৩ বছর মেয়ের হয়ে রাজ্য দেখাশোনা করার পরে ১৮৬০-এ সিকান্দর বেগম নবাব হন এবং ১৮৬৮ পর্যন্ত ভোপালের নবাব পদে আসীন থাকেন। ১৮৬৮-য় সিকান্দর বেগম মারা গেলে শাহ জাহান বেগম ভোপালের নবাব হন। ১৮৬০-এ রিচমন্ড ক্যাম্পবেল ভোপালের নবাব বেগমদের অর্থাৎ, মা ও মেয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করে ভারতে ইংরেজ শাসন বিশেষ ভাবে মজবুত করেন। রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়রের মধুর ব্যবহার ও ভারতের রাজন্যবর্গের সঙ্গে সুসম্পর্ক মহাবিদ্রোহ-পরবর্তী কালে ইংরেজ রাজশক্তির প্রসারণে বিশেষ সাহায্য করে। ১৮৬১ সালে রিচার্ড ক্যাম্পবেল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে ইনদওরে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ঠিক দু’মাস আগে তাঁর পুত্র জন শেক্সপিয়র জন্মগ্রহণ করেন।

ইতিহাসের চাকা চক্রাকারে আবর্তিত হয়। শেক্সপিয়র পরিবারের এই চরাই-উতরাইয়ের ইতিবৃত্তের উপসংহার কিন্তু ‘ট্র্যাজিক’ নয়। কর্নেল স্যর রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়রের ছেলে কর্নেল জন (১৮৬১-১৯৪২) ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির নামকরা অফিসার ছিলেন এবং মিজোরাম ও মণিপুর বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তিনি এই দুই রাজ্যের উপরে কয়েকটি বইও লিখে গিয়েছেন। বর্তমানে আইজল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপরে গবেষণারত বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী। কর্নেল জন নিজেও ইতিহাসচর্চা করতেন। ঠাকুমা এমিলি শেক্সপিয়রের লিখে যাওয়া ১৮১৪-এর ডায়েরি এই কর্নেল জন শেক্সপিয়রই ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজ়েন্ট’ (জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯১০) পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা আজও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য লেখ্যাগারে রাখা আছে।

জন ট্যালবট শেক্সপিয়র এবং তাঁর স্ত্রী এমিলি ১৮১৪ সালে গভর্নর জেনারেল আর্ল অফ ময়রা (ফ্রান্সিস এডওয়ার্ড রাউডন-হাস্টিংস) -র সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে বজরায় ১৪০ দিন কলকাতা থেকে পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন। এই কাহিনি এমিলি তাঁর ডায়েরিতে মনোজ্ঞ ভাষায় লিখে গিয়েছেন। এই ভ্রমণবৃত্তান্তে বিস্তারিত ভাবে ৪০০ বজরা ও নৌকোর একযোগে যাত্ৰা এবং মাঝিদের জীবনের সরস বর্ণনা রয়েছে। এই কাহিনিতে তৎকালীন মুর্শিদাবাদ শহর ও বাংলার নবাব জইন-উদ-দিন আলি খানের হারেম এবং জেনানা মহল সম্পর্কে কটাক্ষও করা হয়েছে। আর এই ডায়েরির মুখবন্ধে লেখা আছে ‘ই’ অক্ষর বর্জিত ‘শেক্সপিয়র’ এবং ‘থ্যাকারে’— এই দুই ইতিহাসখ্যাত পরিবারের ইম্পিরিয়াল ভারতে যুগলবন্দির ইতিবৃত্ত।

১৯১১-র দিল্লি দরবারের নৈশভোজের মেনুকার্ডে শেক্সপিয়র পরিবারের সদস্যদের স্বাক্ষর।

তবে আজকের এই নিবন্ধের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে জন ট্যালবট এবং হেনরি ডেভেনপোর্ট এর ভাই আর্থার শেক্সপিয়র (১৭৮৯ -১৮৪৫)-এর উত্তরাধিকারীকে খুঁজে পাওয়া। আর্থারের উত্তরাধিকারীর নাম নাইজেল শেক্সপিয়র। যিনি জন ট্যালবট, হেনরি ডেভেনপোর্ট ও আর্থারের বংশের ষষ্ঠ পুরুষ।

কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর পরিবারের গল্প লেখার খুশিতে নাইজেল তাঁদের ফ্যামিলি আর্কাইভ থেকে আমাকে উপহার পাঠিয়েছেন স্ক্যান করা এক স্মারক— ১৯১১ সালের দিল্লি দরবারের নৈ ভোজের ফরাসি ভাষায় লেখা কন্টিনেন্টাল খাবারের মেনুকার্ড, যাতে তৎকালীন আট জন শেক্সপিয়র পরিবারের সদস্য স্বাক্ষর করেছিলেন নৈশভোজের শেষে।

আবার বলি, ব্যাপারটা কিন্তু ‘কুম্ভ কি মেলে পে বিছড়ে হুয়ে’ আর একটা ভাই খুঁজে পাওয়ার মতো গল্প, এক্কেবারে শীতে জমে কুলপি। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই, আদৌ কি আমাদের নাইজেল শেক্সপিয়রের সঙ্গে পরিচয় ঘটত, যদি সমাজমাধ্যম না থাকত?

(ছবি সৌজন্য: লেখক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement