Lifestyle News

স্টেম সেল-এর বন্ধনে বাঁচল জীবন, অনাত্মীয় হয়ে উঠলেন পরমাত্মীয়

প্রোক্যাম বিজনেস গ্রুপের ডিরেক্টর ৪২ বছরের নীলেশ কুমার সিংহ ও ২৭ বছরের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সজত জৈন। আপাত ভাবে দেখতে গেলে দু’জনের মধ্যে মিল শুধু একটাই। দু’জনেই দিল্লির বাসিন্দা।

Advertisement

প্রমা মিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৬:২৬
Share:

প্রোক্যাম বিজনেস গ্রুপের ডিরেক্টর ৪২ বছরের নীলেশ কুমার সিংহ ও ২৭ বছরের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সজত জৈন। আপাত ভাবে দেখতে গেলে দু’জনের মধ্যে মিল শুধু একটাই। দু’জনেই দিল্লির বাসিন্দা। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭-র বেলা ১২টা পর্যন্ত তাঁরা চিনতেন না একে অপরকে। জানতেনও না একই শহরের বাসিন্দা হওয়া ছাড়াও তাদের রয়েছে আরও একটা মিল। যে মিলের জেরেই এক জন আর এক জনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন মাত্র এক বছর আগে। হ্যাঁ। সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অনাত্মীয় এই দু’জনের মিল রয়েছে তাঁদের জিনের গঠনে।

Advertisement

২০১৪ সালে দুরারোগ্য ব্যাধি অ্যাপ্ল্যাস্টিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন নীলেশ। বাঁচার একমাত্র উপায় স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট। স্টেম সেল দাতা খুঁজতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দাত্রী’র। তাদের মাধ্যমেই পেয়ে যান দাতা। চিকিত্সায় সুস্থ হয়ে ওঠেন ধীরে ধীরে। চিকিত্সার প্রোটোকল অনুযায়ী এক বছর পর্যন্ত দাতা বা গ্রহীতা কেউ কারও পরিচয় জানতে পারেন না। এক বছর পর দু’পক্ষেরই সদিচ্ছা থাকলে তাদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দাত্রী। বৃহস্পতিবার প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কলকাতার প্রথম ডোনার-রেসিপিয়েন্ট মিট। মঞ্চে উঠে হাত মেলালেন সজত ও নীলেশ। জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। উপস্থিত ছিলেন দাত্রী-র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রঘু রাজাগোপাল, টাটা মেডিক্যাল ও ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর চিকিত্সক মামন চণ্ডী, অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিত্সক সৌম্য ভট্টাচার্য এবং এএমআরআই-এর চিকিত্সক জয়দীপ চক্রবর্তী। উদ্দেশ্য একটাই। স্টেম সেল দান ও প্রতিস্থাপন সম্পর্কে সচেতনতা গ়ড়ে তোলা। যা সম্পর্কে এখনও বিশেষ ধারণা নেই সাধারণ মানুষের। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিছু সহজ প্রশ্নের উত্তর।

স্টেম সেল কী?

Advertisement

বোন ম্যারোতে থাকা অপরিণত কোষকে বলা হয় স্টেম সেল। এই স্টেম সেল আলাদা আলাদা ভাবে রক্তে লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা ও অনুচক্রিকা তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় হেমোটোপিসিস। হেমোটোপিসিসের সাহায্যে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রতি দিন ২০,০০০ কোটি নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়।

হেমোটোপেটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন–এর (HSCT) মাধ্যমে ঠিক কী করা হয়?

এই পদ্ধতিতে দাতার শরীর থেকে ব্লাড স্টেম সেল নিয়ে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।

দাতা ও গ্রহীতার কোন কোন বিষয় ম্যাচ করা প্রয়োজন?

স্টেম মেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখা হয় হিউম্যান লিম্ফোটিক অ্যান্টিজেন বা এইচএলএ (HLA)। এই এইচএলএ-র মোট ১০টি ফ্যাক্টর থাকে। ম্যাচ র‌্যাঙ্কের মাধ্যমে এই ফ্যাক্টরগুলো মিলিয়ে দেখা হয়। যদি দশটি ফ্যাক্টরই মিলে যায় তা হলেই ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। খুব কম অসুখের ক্ষেত্রে যেখানে ঝুঁকির মাত্রা কম সেখানে দশের মধ্যে নয়টি ফ্যাক্টর মিললেও ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়ে থাকে।

কারা হতে পারেন দাতা

১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কোনও কেউ স্টেম সেল দাতা হতে পারেন। দাতা হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের বয়সের সীমা ৫০ হলেও ৬০ বছর পর্যন্ত স্টেম সেল দান করা যেতে পারে। অ্যাস্থমা বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকলে স্টেম সেল দান সম্ভব নয়।

কোন পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হয় স্টেম সেল?

দু’টি পদ্ধতিতে স্টেম সেল গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এক, বোন ম্যারো থেকে সরাসরি স্টেম সেল নেওয়া হয়। দুই, গ্র্যানিওলোসাইট কলোনি স্টিমিউলেটিং ফ্যাক্টর বা জি-সিএসএফ (G-CSF)-এর সাহায্যে স্টেম সেল বোন ম্যারো থেকে রক্তে মোবিলাইজ করা হয়। এরপর রক্ত থেকে স্টেম সেল গ্রহণ হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পেরিফেরাল ব্লাড স্টেম সেল (PBSC) হারভেস্ট প্রসিডিওর।

স্টেম সেল দান কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

টাটা মেডিক্যাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর চিকিত্সক মামন চণ্ডী জানালেন, আমরা প্রতি দিন রাস্তা পার হই। কলকাতায় রাস্তা পার হওয়া কি ঝুঁকিপূর্ণ নয়? কিন্তু না ভেবেই প্রতি দিন তা করছি। বলতে পারি, স্টেম সেল ডোনেশন কলকাতায় রাস্তা পার হওয়ার থেকে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ।

দাতার কী ভাবে নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন

হেমোটোপিটিক মেশিনারির মেটাবলিক ইনডেক্স খুব বেশি হওয়ার কারণে রক্তে যথেষ্ট পুষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। রক্তে স্টেম সেলের মোবিলাইজেশনের জন্য তিনটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হল আয়রন, ভিটামিন বি১২ ও ফোলিক অ্যাসিড। এই তিনটের কোনও একটার ঘাটতি হলে রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্টেম সেল মোবিলাইজেশন হবে না। সেই কারণে দাতাকে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ফোলেট ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়ে থাকে।

পিবিএসসি পদ্ধতিতে স্টেম সেল নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ত যাতে জমাট বেঁধে না যায় তার জন্য শরীরের বাইরে থেকে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট দেওয়া হয়ে থাকে। এই অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ভাল ভাবে কাজ করার জন্য শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে দাতার হাত, পা অবশ হয়ে যাওয়া, ঘুম পাওয়া, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে বুকে ব্যথাও হতে পারে। তাই স্টেম সেল গ্রহণের আগে থেকে দাতাকে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়াও দুধ, চিজ, দই, পনির, সয়, কলা, পালং শাক, আমন্ড, কড়াইশুঁটি, বিনস জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কী ভাবে বেছে নেওয়া হয় দাতা

রঘু রাজাগোপাল জানালেন, স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হলে প্রথমে রোগীর নিজের ভাই, বোন বা পরিবারের কারও এইচএলএ মিলিয়ে দেখা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এইচএলএ ম্যাচ করার সম্ভাবনা মাত্র ২৫ শতাংশ। তাই দাতার উপর নির্ভর করতেই হয়। যে কোনও দেশের যে কোনও কারও সঙ্গেই আমাদের এইচএলএ স্ট্রাকচার ম্যাচ করতে পারে। কিন্তু আমাদের জিনের গঠনে ভৌগোলিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতীয় গ্রহীতার জন্য যদি ভারতীয় দাতা বা দক্ষিণ এশীয় দাতা পাওয়া যায়, তা হলে চিকিত্সার সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তবে এ ভাবে দাতা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। কারণ আমরা নিজেদের রক্তের গ্রুপ জানলেও এইচএলএ টাইপিং কেউই জানি না। দাত্রী এই কাজটাই করে। দাতারা দাত্রীর মাধ্যমে নিজেদের রেজিস্টার করেন। এরপর বিভিন্ন হাসপাতালের মাধ্যমে রোগীরা যোগাযোগ করলে দাত্রী নথিভুক্ত দাতাদের এইচএলএ টাইপিং মিলিয়ে দেখে ম্যাচ তৈরি করে।

কতটা সচেতন মানুষ?

দাত্রীর কর্পোরেট রিলেশনস পার্টনার গায়ত্রী শেনয় জানালেন, রক্তদান সম্পর্কে মানুষের ধারণা থাকলেও স্টেম সেল কী, ঠিক কী ভাবে দান করা হয়, এতে কোনও সমস্যা হয় কি না সে বিষয়ে কোনও স্বচ্ছ ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে। অন্য দিকে, নাম নথিভুক্ত করলেও অনেকেই দান করার সময় পিছিয়ে গিয়েছেন। কোনও অপরিচিত, অনাত্মীয় ব্যক্তিকে নিজের স্টেম সেল দান করার ব্যাপারে এখনও মানসিক বাধা রয়েছে। আজ আমি কাউকে স্টেম সেল দিতে পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কাল আমিও এক জন রোগী হতে পারি এই ভাবনাটা এখনও গড়ে ওঠেনি। এই জন্যই আমরা এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি যেখানে দাতা ও গ্রহীতা একে অন্যের সঙ্গে দেখা করছেন। দু’জনেই প্রক্রিয়ার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠছেন। এই ভাবেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন