গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন প্রতি দিন একটু একটু করে বেড়ে চলেছে সামাজিক অপরাধ আর আরও বেশি করে বেড়ে চলেছে ধর্ষণ। এক দশকের একটু বেশি সময় পেরিয়েছে, যখন দিল্লির রাস্তায় মধ্যরাতে ধর্ষিতা হয়েছিলেন একটি মেয়ে এবং সেই বীভৎস ধর্ষণের কথা জেনে কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ। মেয়েটির যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধারালো অস্ত্র। কিন্তু মেয়েটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নির্ভয়া’। ঠিক এক বছর আগে আরজি করের এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সমস্ত বিশ্ব। মেয়েটির চোখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল, আমরা শুনে কেঁপে উঠেছিলাম, অথচ তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অভয়া’। আমাদের মনে পড়বে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে সকল মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন, তাঁদের বলা হয় ‘বীরাঙ্গনা’।
প্রতি বার ভাবতে বসলে মনে হয়, কে নির্ভয়া? কে অভয়া? কে বীরাঙ্গনা? কেন তাঁদের এ সব নামে ভূষিত করা হবে? আমাকে ধর্ষণ করা হলে কেন আমাকেই নির্ভীক হতে হবে, আমাকেই হতে হবে বীর? আমার সামাজিক পরিকাঠামো, আমার রাষ্ট্র, আমার আইন, আমার সরকার আমাকে দেবে না সেই নিরাপত্তা? তা হলে আর সভ্যতার অর্থ কী? সভ্যতার ইতিহাসের দিকে পিছিয়ে গেলে আমরা দেখব ধর্ষণের সংজ্ঞা ক্রমে বদলে বদলে গিয়েছে। ভিন্ন সভ্যতায় তাকে ভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এক সময়ে যে মেয়েরা দাসপ্রথায় নিযুক্ত থাকত, তারা ধর্ষণের অভিযোগ করতে পারত না, কারণ ধরেই নেওয়া হত তাদের শরীরের উপর তাদের মালিকের অধিকার। একমাত্র প্রতিবাদ করতে পারত সেই নারীরা, যারা মুক্ত ছিল, অর্থাৎ, দাসপ্রথার বাইরে ছিল। কিন্তু সেই সকল নারীর ক্ষেত্রেও ধর্ষণ ছিল যত না সেই নারীর উপর হওয়া অন্যায়, তার চেয়ে বেশি করে ছিল তার পিতা কিংবা স্বামীর উপর হওয়া অন্যায়।
সভ্যতার ইতিহাসের দিকে পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে ধর্ষণের সংজ্ঞা ক্রমে বদলে বদলে গিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।
ঠিক কেন এমন ভাবনা? কারণ, কুমারী নারীর যৌনতা অক্ষত রাখার দায় তার পিতার আর বিবাহ পরবর্তী সময়ে তা রক্ষা করার দায় স্বামীর, এমনই ধারণা প্রচলিত। অতএব, কোনও নারীকে ধর্ষণ করা মানে ধরে নেওয়া হয় যে, তা আসলে সেই নারীর পিতা বা স্বামীর অপমান।
যে ভাবে যুদ্ধের সময়ে একে অন্যের রাজ্য, জমি লুট করে পরাজিত করা হয় অপর পক্ষকে, ধর্ষণও যেন খানিক তেমন, সম্পত্তি লুণ্ঠনের মতো। তাই তো প্রতিটি যুদ্ধের অংশ হয়ে ওঠে ধর্ষণ। এমনকি, প্রাচীন ইহুদি আইনে ধর্ষণকে দেখা হত ‘চুরি’ হিসেবে। কিসের চুরি বা কী চুরি? কৌমার্যের! যেন একটি মেয়ের কৌমার্য তার পিতা বা স্বামীর দেরাজে রাখা অমূল্য রতন। তা হরণ করতে পারলেই যেন যুদ্ধ জয় করা যাবে।
সেখান থেকে তো আজকের সভ্যতা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। অন্তত উচিত তো ছিল তেমনই। এমনকি, ২০১৮-র পরকীয়া আইন সংস্কারের সময়ে পূর্ববর্তী সেই ঘৃণ্য আইন থেকে মুক্তি পেল নারী সমাজ। কী ছিল সেই আইন? যে পরকীয়ায় দোষী হবে একটি পুরুষ যে এক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে, তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া। কী ভয়ঙ্কর! তার মানে একটি মেয়ের যৌনতার উপর কোনও অধিকারই ছিল না তার নিজের? আরও ভয়ঙ্কর হল যে, যদি স্বামীর অনুমতি থাকে, তা হলে কি সে বাধ্য অন্য কারও সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে? আমরা অভিযোগ শুনেছি, সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডের এক নামকরা তারকার স্বামী তাঁকে বাধ্য করেছিলেন এমন একটি কাজে। কিন্তু আজ যখন আপাত ভাবে এই সব আইনকে পিছনে ফেলে এলাম আমরা, আজ যখন ইন্ডিয়ান পিনাল কোড থেকে ভারতীয় ন্যায়সংহিতায় বদলের পর আমরা পেলাম আইপিসি ৩৭৬ থেকে বিএনএস ৬৪, যেখানে গ্যাং রেপকে আরও জোর দিয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে দেখা হল, তখনও সমাজে ধর্ষিতা হয়ে মেয়েদের নির্ভয়া-অভয়া হতে হচ্ছে কেন?
প্রতিবাদের ভাষা বদলেছে। ছবি: সংগৃহীত।
হ্যাঁ, মেয়েরা নির্ভীক হয়েছে বইকি! আজ যখন একটি আইনের কলেজে একটি মেয়ে অভিযোগ আনছে তার বিরুদ্ধে হওয়া গণধর্ষণের, তাকে আলাদা করে কোনও নাম দেওয়া হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সে সত্যিই আমাদের কাছে নির্ভয়া, অভয়া, বীরাঙ্গনা। কিন্তু প্রশ্ন অন্যখানে, এই ভাবে মেয়েদের বোঝাতে হবে যে তারা বীর? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ মনে পড়ে যায়। “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই”! আর কত বার মেয়েদের ধর্ষিতা হয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা নির্ভীক ছিল, তারা বীর ছিল? কিংবা হয়তো ছিল না, জোর করে হতে হল। সে হয়তো ছিল ভীতু, পেলব, নরম। এই সমাজে ভীতু, পেলব, নরম মেয়েরা বাঁচতে পারবে না?
তা হলে সে সভ্যতার অর্থ কী? গুহা থেকে ঘর হল, জঙ্গল থেকে রাস্তা, তবু আমরা নিরাপদ হলাম না? তা হলে ভাবতে হবে যে, এত কিছু বদল হওয়ার পরও ঠিক কী বদল হল না? আসলে বদল হল না বোধহয় মন আর ক্ষমতার খিদে কিংবা খিদের রাজনীতি।
রাজনীতি বললে আমাদের দলীয় রাজনীতির কথাই মাথায় আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষত সেই সমাজে, যে সমাজে বার বার নাম উঠে আসছে দলীয় রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা মানুষদের। কখনও সরাসরি দলীয় রাজনীতির ময়দান বীরের মালা পরাচ্ছে ধর্ষককে, কখনও গণধর্ষণের পর সেই ধর্ষকের ভিডিয়ো ফুটেজে আমরা শুনছি সে বলছে যে, কেউ তার কিচ্ছু করতে পারবে না। অতএব ক্ষমতা আর ধর্ষক বার বার মিলে যাচ্ছে।
ঠিক এখান থেকেই দলীয় রাজনীতি থেকে সরে (সরিয়ে রেখে নয়) আমি এক বার দেখতে চাই ধর্ষণের রাজনীতিকে। কেন এই দুই রাজনীতি মিলে যায় বার বার? কোথাও কি সেতু আছে কোনও? আমরা ধর্ষণ শব্দটা ভাঙলে দেখব এর ভিতর লুকিয়ে আছে ‘ধৃষ’ ধাতু, যার অর্থ সাহস করা বা জোর করা। ধৃষ ধাতু থেকে যখন ধৃষ্টতার মতো শব্দ তৈরি হবে, তখন এই সাহস করার অর্থটা ব্যবহৃত হবে। কিন্তু যখন তৈরি হবে ধর্ষণের মতো শব্দ, তখন অবশ্যই যে অর্থটি জুড়ে থাকবে তা হল ‘জোর করা’। ‘বলাৎকার’ শব্দের ভিতরও আছে বলপ্রয়োগ করা। ইংরেজি শব্দ ‘রেপ’-এর দিকে যদি তাকাই আমরা, দেখব শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘রেপেরে’ থেকে। যার অর্থ বলপূর্বক ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া বা দখল করা। অর্থাৎ, শব্দগুলির ভিতর রয়েছে জোর করা, বল প্রয়োগ করা বা ছিনিয়ে নেওয়া। এক কথায় বলতে গেলে ‘ক্ষমতা’র প্রদর্শন।
গুহা থেকে ঘর হল, জঙ্গল থেকে রাস্তা, তবু আমরা নিরাপদ হলাম না? ছবি: সংগৃহীত।
এ বার এই ক্ষমতা যখনই জুড়ে যাবে কোথাও, তখনই চলে আসবে ক্ষমতার রাজনীতি। আর ক্ষমতার রাজনীতি কখনও হবে দলীয় রাজনীতি, কখনও বা লিঙ্গরাজনীতি, কখনও বা ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির রাজনীতি। উল্টো ভাবে দেখতে গেলে এই সব রাজনীতি আসলে সর্বদাই ক্ষমতার রাজনীতি। ধর্ষণ তাই সর্বদাই ক্ষমতার রাজনীতির অংশ, কিন্তু তাকে কেবল দলীয় রাজনীতির লেন্স দিয়ে দেখলে তার সাময়িক নিষ্পত্তি ঘটলেও থেকে যাবে তার বীজ, যদি না তাকে লিঙ্গরাজনীতির লেন্স দিয়ে আমরা দেখি। বলপ্রয়োগ করা বা ক্ষমতার ‘ট্রিপ’ মানুষের অ্যাড্রিনালিন হরমোনের বৃদ্ধি ঘটায় আর নারীশরীর বা নারীর যৌনতা যে তার নিজের নয়, এমন একটা ধারণা আইনে বদলে গেলেও সমাজের ভিতর এখনও তিরতির করে বয়ে চলে। তাই নির্ভয়ার উপর ওই প্রচণ্ড অত্যাচারের সময়ে যখন আমরা বিস্মিত হচ্ছি জেনে যে, একটি ছেলের বয়স তখন ছিল ষোলো বছর, তখন তার কাছে বোধ হয় সে দিন সেটা কোনও নারীর শরীর ছিল না, বরং যে ভাবে পর্বত আরোহণের পর পতাকা পুঁতে দেওয়া হয়, কিংবা পাহাড় থেকে বেরিয়ে ফেরার সময়ে মানুষ প্লাস্টিকের বোতল, জঞ্জাল সব ফেলে আসে পাহাড়ের গায়ে, সে ভাবেই নারীশরীরকে দেখেছিল সে বা তারা। মধ্যরাতের ‘ক্ষমতার’ ট্রিপের সেটাই দাবি ছিল। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মালা পরানো হয় যখন, সেটাও আসলে একটা বার্তা দেয়, ক্ষমতার। মেয়েদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, যে কথা শুনে না চললে এরা কিন্তু আছে সমাজে। যে ভাবে ছোটবেলায় ভাত না খেলে ‘জুজু’র ভয় দেখানো হত।
সাম্প্রতিক সময়ে কসবা ল’কলেজের ধর্ষণে অভিযুক্ত যুবককে যখন সঙ্গ দেন আরও অনেকে, কেউ ভিডিয়ো করে, কেউ পাহারা দিয়ে। তারা আসলে সকলে মিলে একটা ক্ষমতা প্রয়োগের অংশ হয়ে ওঠেন, ‘ভয়েরিসম’-এর পাশাপাশি। আর এখানেই মিলেমিশে এক হয়ে যায় লিঙ্গরাজনীতি ও দলীয় রাজনীতি। এক জন মানুষ, যিনি লিঙ্গপরিচয়ে পুরুষ, তিনি যখন দলীয় ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকেন কোনও ভাবে এবং তিনি যখন ধর্ষণ করেন, তখন সেই ধর্ষণ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার। অন্তত তিনি তা-ই ভাবেন। ‘ভয় দেখানো’-র রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায় ‘ভোগ করার’ রাজনীতি। ‘মি টু’-র নিরিখে কনসেন্টের যত গুরুত্ব আছে, আমার কাছে ‘ধর্ষণের’ নিরিখে নেই। কারণ, যিনি ধর্ষক, তিনি কনসেন্ট দূরস্থায়ী, বলপ্রয়োগ করবেন বলেই স্থির করেছেন। এটা তাঁর সিদ্ধান্ত। তবু এ কথা বলতেই হয়, আমাদের সমাজ, বিনোদন, লেখাপড়া কেউই আমাদের কনসেন্টের ধারণাকে স্পষ্ট করেনি। আর সেই ধারণা তত দিন স্পষ্ট হবে না, যত দিন না যে কোনও মানুষের শরীর আর যৌনতাকে তাঁর নিজের বলে ভাবতে শিখব আমরা। সমস্ত আইন, অধিকাংশ ধর্ষণ এবং আমাদের লিঙ্গরাজনীতির ইতিহাস আমাদের এক ধরনের নারী-পুরুষের বাইনারির দিকে ঠেলে দেয় ঠিকই কিন্তু এর উল্টোটা বা এর বাইরেটাও সত্যি। যেখানে এক জন শিক্ষিকা এক নাবালক স্কুলপড়ুয়া ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করে, এখানে মাথায় রাখতে হবে, শিক্ষিকা লিঙ্গের নিরিখে না হলেও ক্ষমতার নিরিখের, পদের নিরিখে বলবান এবং সে বিষয়ে সে সচেতন। এখানেও তাই সেই ক্ষমতার রাজনীতি। নারী-পুরুষেরও বাইরে ট্রান্স মানুষদের, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাছ থেকে ধর্ষণের অভিযোগ আসে কই? তার মানে কি তাঁরা ধর্ষণের শিকার হন না? নিশ্চিত ভাবে দৃশ্যটা, তা নয়। এবং তা আমরা জানি। ধর্ষণকে এখনও আমরা নারীশরীর দিয়েই দেখতে অভ্যস্ত, তার বাইরে এখনও সমাজ অন্ধ। কিন্তু আমরা তো জানি “অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?” ধর্ষণকে বুঝতে হলে ক্ষমতাকে বুঝতে হবে আরও সামগ্রিক ভাবে।