gene

কেউ সুস্থ, কেউ মৃত, অতিমারির রহস্য মানব জিনে

কিছু মানুষের যখন করোনা সংক্রমণের জেরে ভয়ানক বাড়াবাড়ি অবস্থা হতে দেখা গিয়েছে, তখন কিছু লোকজনকে দেখা গিয়েছে তাঁরা কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসেও সংক্রমিত হননি বা সংক্রমিত হলেও তাঁদের কোনও উপসর্গই ছিল না।

Advertisement

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:৩১
Share:

গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘জিন’-এ। ফাইল ছবি

টানা তিন মাস আইসিইউ-এ থাকার পর হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় ফিরতে পেরেছিলেন অনির্বাণ। ভাল হয়ে বাড়ি ফিরতে আরও একটা মাস লেগে গিয়েছিল বছর চল্লিশের এই সুস্থ-সবল তরুণের। কোভিডের সেই বিভীষিকার সাক্ষী হয়েছিলেন আরও অনেক পরিবার। এ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে ৬০ কোটির বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ লক্ষ ৮১ হাজার জন। কিন্তু কিছু মানুষের যখন করোনা সংক্রমণের জেরে ভয়ানক বাড়াবাড়ি অবস্থা হতে দেখা গিয়েছে, তখন কিছু লোকজনকে দেখা গিয়েছে তাঁরা কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসেও সংক্রমিত হননি বা সংক্রমিত হলেও তাঁদের কোনও উপসর্গই ছিল না, তাই ধরা পড়েনি। কেন এই বৈপরীত্য? এরই উত্তর জানতে গবেষণা শুরু করেছিলেন আইআইএসইআর (মোহালি)-র বিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, উত্তর লুকিয়ে আছে মানব জিনেই।

Advertisement

এই গবেষণায় ইন্দ্রনীল ছিলেন প্রধান তদন্তকারী বিজ্ঞানী। তাঁর দলে ছিলেন তিন গবেষক-পড়ুয়া— কাজল গুপ্ত, গগণপ্রীত কৌর, তেজল পাঠক। তাঁরা জানিয়েছেন, কোভিডে এই বাড়াবাড়ির জন্য দায়ী মানুষেরই কিছু জিন ভেরিয়েন্ট। ‘অপরাধী’ ৭টি জিনকে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘জিন’-এ।

অতিমারির গোড়ার দিকে একটি ঝুঁকির তালিকা তৈরি করা হয়েছিল সব দেশেই। সতর্ক করা হয়েছিল, যাঁদের বয়স হয়েছে, কিংবা যাঁরা অন্য কোনও রোগে এমনিতেই শারীরিক ভাবে দুর্বল, তাঁদের কোভিড সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। প্রবল ঠান্ডাতে এই রোগ বাড়তে পারে বলেও প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে সব অনুমান ওলটপালট করে দিয়ে বহু তরুণ তরতাজা প্রাণকে কোভিডের বলি হতে দেখা গিয়েছে গত দু’বছরে। উল্টো দিকে, বহু প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছে করোনা সংক্রমণে সামান্যই অসুস্থ হতে!

Advertisement

বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ছিল, ভাইরাস নয়, এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মানব দেহেই। ইন্দ্রনীল ও তাঁর দল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কোভিড সংক্রমিতদের থেকে সংগৃহীত তথ্য এক জায়গায় করে বিশ্লেষণ করা শুরু করেন। এর আগেও এমন ধরনের কিছু গবেষণা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি খুব অল্প সংখ্যক তথ্য নিয়ে করা হয়েছিল। ফলে স্পষ্ট উত্তর মেলেনি।

ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, তাঁদের গবেষণায় তাঁরা চেষ্টা করেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যত বেশি সম্ভব রিপোর্ট একত্রিত করে তার গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে যুক্ত জেনেটিক অ্যাসোসিয়েশনগুলির সমস্ত রিপোর্ট, অন্যত্র পাওয়া তথ্য, জিন মিউটেশন সংক্রান্ত তথ্য (২০২২ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত)— সব তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখেন। ৬১টি জিনে ১৩০টি মিউটেশন চিহ্নিত হয়েছে, এমন ৮৪টি রিপোর্ট খতিয়ে দেখে এই বিজ্ঞানীদল। তাঁরা জানিয়েছেন, ১৫,৫৫০ জন কোভিড পজ়িটিভ রোগী এবং ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ৭ জন সুস্থ ব্যক্তির ক্লিনিক্যাল ও জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। এ ভাবে ৭টি ‘সন্দেহজনক’ জেনেটিক ভেরিয়েন্ট খুঁজে পান তাঁরা। দেখা যায়, এসিই১, এপিওই, সিসিআর৫, আইএফআইটিএম৩ জিন ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।

গবেষণার পরবর্তী ধাপে বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখেন, সংক্রমিতদের মধ্যে যাঁদের সঙ্কটজনক অবস্থা হয়েছিল, তাঁদের কেন তা হয়েছিল। কোভিডে গুরুতর অবস্থা হয়েছিল, এমন ৬৭০২ জনের (এর মধ্যে অনেকে মারাও যান) জেনেটিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে এমন ৮৬৪০ জন সংক্রমিতের তথ্য একত্রিত করা হয়, যাঁদের অল্প অসুস্থতা ছিল। এঁদের সকলের ১১টি জিন ভেরিয়েন্টকে খতিয়ে দেখা হয়। মেটা-অ্যানালিসিসে দেখা যায়, সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য দায়ী এসিই২, এজিটিআর১ এবং টিএনএফএ জিন ভেরিয়েন্ট।

ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, গোটা পৃথিবীতে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের যাবতীয় জিন-তথ্য এক জায়গায় করে যে ‘মেটা-অ্যানালিসিস’ তাঁরা করেছেন, তা এই প্রথম। ইন্দ্রনীল বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণা দেখিয়ে দিয়েছে, কোভিডে সঙ্কটজনক অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য বয়স, ধূমপানের প্রবণতা, কো-মর্বিডিটির পাশাপাশি আমাদের দেহের জিন ভেরিয়েন্টগুলিও দায়ী।’’ কোভিডের সঙ্গে জড়িত মানব দেহের ‘অপরাধী’ জিন ভেরিয়েন্টগুলিকে চিহ্নিত করা জরুরি ছিল। এতে সত্যিই কারা ঝুঁকির তালিকায় রয়েছেন, তা জানা সম্ভব হবে। রোগ সংক্রমণের গতিবিধি সম্পর্কে ভাল করে বোঝা যাবে। ভবিষ্যতে আরও কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থারও সন্ধান মিলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন