অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
উটের গ্রীবার মতো যে নিস্তব্ধতার কথা জীবনানন্দ বলেন, তাকে আজ গড়ানে বয়সের মানুষ হাড়ে হাড়ে চেনে। বয়স এমন এক বিপন্নতা, যার কোনও ওষুধ নেই, নিরাময় নেই।
এখন যখন পৃথিবীতে জনসংখ্যা হেমন্তের শ্যামাপোকার মতো গিজগিজে, তখন মানুষ যে কেন আরোতরো একা হয়ে যাচ্ছে, তার জবাব কে দেবে! এখন আমাদের বাস নিজস্ব বুদ্বুদের মধ্যে। যোগাযোগহীন। গায়ে গায়ে মানুষ, কিন্তু যেন লক্ষ যোজন ফাঁক। মানুষ মেলা, কিন্তু জন নেই। আপনজন নেই। আমার দেশ ছিল বিক্রমপুর। বানভাসি অঞ্চল। রুজি-রোজগারের অভাবহেতু পুরুষদের প্রবাসে যেতেই হত। তবু সংসার জনশূন্য হয়ে যেত না। বেকার পুরুষ, বিধবা আত্মীয়া, আশ্রিত মানুষের অভাব হত না। তারা মানবসম্পদ হয়তো নয়, কিন্তু ঠেকনোর কাজ করত। বাঙালদের আত্মীয়-বাৎসল্য খুব। কিন্তু এখন শহরে, মফস্সলে আমাদের জীবন মথিতকরে হেঁটে চলেছে জীবনানন্দের উট।
এই একা হওয়া আমাদের প্রার্থিত ছিল না তো! আমরা চাইনি একে। তবু এ তো পাকে-প্রকারে আমাদেরই কর্মের ফল! এই তো সে দিন খবরের কাগজে দেখলাম, এক বুড়ো মানুষ পয়সা খরচ করে নাতি ভাড়া করেছেন! সে কিছু ক্ষণ সঙ্গ দেবে, গল্প করবে, একসঙ্গে বসে খাবে, তার পরে বিদায় নিয়ে আবার পরস্য পর হয়ে যাবে। আমার জানা ছিল না, ভাড়াটে আপনজনও পাওয়া যায় আজকাল! পাড়ার এক দোকানির সঙ্গে বেশ খাতির ছিল আমার। তাঁর স্ত্রী হঠাৎ মারা যাওয়ায় তিনি এমন একটা অর্থহীনতায় উপনীত হলেন যে, বেঁচে থাকার আর কোনও উদ্দেশ্যই খুঁজে পেলেন না। অনেকটা সহমরণের মতোই অনতিবিলম্বে প্রস্থান করলেন তিনিও।
আরও পড়ুন: শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে-ই একা
বেহালার রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মীনাক্ষীদেবীর মৃত্যুর পরে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে মৃত্যু ডেকে আনায় প্রশ্ন উঠবে, সত্তর বছর বয়সে কেউ কি পারে এ রকম রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতে? কতটা মরিয়া হলে, হন্যে হয়ে উঠলে এই কাণ্ড করা যায়! রথীন্দ্রনাথ আসন্ন বিরহ এবং উটের গ্রীবার মতো এগিয়ে আসা নিস্তব্ধতা আর নিঃসঙ্গতাকে কতটা ভয় পেয়েছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা নেই। এ এমন এক প্রতিপক্ষ, যার সঙ্গে লড়াই চলে না। সবাই হার মেনে নেয়, এমন নয়। সঙ্গিনী চলে যাওয়ার পরেও অনেকে বেশ বেঁচেও তো থাকে! একাকিত্বকে অনেকে উপভোগও করে তো! কিন্তু কেউ কেউ হেরেও তো যায়! লক্ষ করলে দেখতে পাই, আজকাল হেরো মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এমনকী, বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল, তবু জীবনানন্দের পুরুষটি কোন বিপন্ন বিস্ময়ে দড়ি হাতে নিশুত রাতে গাছের কাছে চলে গিয়েছিল, তা কে বলবে?
কারও কারও কাছে জীবন আচমকা অর্থহীন হয়ে যায় হয়তো। একা হয়ে যাওয়ার ভয় এসে আকন্ঠ চেপে ধরে। তখনই জীবন থেকে পালানোর ইচ্ছে জাগে। শুধু নিজেকে নিয়ে, নিজের গুটিকয় প্রিয়জন নিয়ে বেঁচে থাকলে এ রকম হতে পারে। আমরা ক’জনই বা বৃহৎ জীবন যাপন করতে পারি! দুনিয়ায় এখন হেরো মানুষের সংখ্যাই তো বেশি।
তবু রথীন্দ্রনাথ যে ভাবে বিদায় নিলেন, তা যেন আমাদের প্ররোচিত না করে। জীবন কোনও না কোনও ভাবে সর্বদাই যাপনযোগ্য। এই জীবন আমার অর্জিত নয়। তাকে বিসর্জন দেওয়ার অধিকারও বোধ হয় আমাদের নেই।
আমি যে পাড়ায় থাকি, সেখানে একা বুড়ো বা একা বুড়ির অভাব নেই। কারও সঙ্গে কাজের লোক থাকে, কেউ বা একদম একা এবং অকুতোভয়। এই একাদের সঙ্গে কথা কয়ে দেখেছি, তাঁরা দিব্যি থাকেন। টিভি বা বই না হলেও তাঁদের বেশ চলে যায়। তাঁরা বলেন, ভয়? না না, ভয় কীসের? একাও লাগে না তো! ওটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
আবার এ কথাও ঠিক যে, সবাই তো এক ছাঁচে তৈরি নয়। রথীন্দ্রনাথ পারলেন না। এই বেদনাদায়ক ঘটনাটি অনেকের মর্ম স্পর্শ করবে। তবু বলতে ইচ্ছে করে, হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় বাকি।
(আনন্দবাজার পত্রিকায় ২১ মার্চ, ২০১৮-য় প্রকাশিত।)