অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ করছেন বিএমওএইচ। —নিজস্ব চিত্র।
মাত্র দু’মাস আগে একজন চিকিৎসক পাওয়া গিয়েছিল। তাঁকেও তুলে নেওয়ার নির্দেশে রাস্তায় নামলেন বরাবাজারের সিন্দরি গ্রামের বাসিন্দারা। তার জেরে সোমবার সকাল থেকে বরাবাজার-মানবাজার রাস্তা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকল। বাসিন্দাদের চাপে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে ওই চিকিৎসককে রেখে দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে অবরোধ ওঠে।
ঘটনাটি সিন্দরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। এ দিন সকালে সিন্দরি বাজারে গিয়ে দেখা গেল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গেটের সামনে রাস্তার উপরে আড়াআড়ি বেঞ্চ পেকে রেখেছেন বাসিন্দারা। অবরোধের জেরে দু’ধারে ছোট বড় অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। মানবাজার-বরাবাজার রাস্তার উপর গ্রামবাসীরা বসে। অবরোধে সামিল সিন্দরি পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান ও সদস্যরাও। প্রধান বিশ্বজিৎ মাহাতো জানান, ১০ শয্যার এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আগে দু’জন চিকিৎসক ছিলেন। এক বছর আগে এক জন বদলি হন। পরিবর্তে কেউ না আসায় শ্যামকিঙ্কর কুইরি নামে এক জন চিকিৎসকই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাচ্ছিলেন। দু’মাস আগে বিস্বন ওঝা নামে আর এক চিকিৎসক এখানে যোগ দেওয়ার পরেই শ্যামকিঙ্করবাবুকে বরাবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তুলে নেওয়া হয়। আবার দু’দিন আগে বিস্বনবাবু জানান, তাঁকেও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বরাবাজারের দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই খবর এলাকায় প্রচার হওয়া মাত্র ক্ষোভ ছড়ায়। তার জেরেই এ দিনের অবরোধ। সিন্দরি পঞ্চায়েতের সদস্য ইন্দ্রজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর অন্তত কুড়িটি গ্রামের বাসিন্দারা নির্ভরশীল। লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকেও রোগীরা এখানে আসেন। চিকিৎসকই যদি না থাকে তা হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র রেখেই বা কী লাভ?’’ এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এখান থেকে বরাবাজারের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতাল ১৮ কিলোমিটার দূরে। বরাবাজার-মানবাজার রাস্তার উপরে আর কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় আশপাশের সবাই সিন্দরিতেই আসেন। তাঁদের ক্ষোভ, ‘‘বিভিন্ন সময় এখান থেকে চিকিৎসক তুলে নেওয়ার নজির আছে। আমাদের আন্দোলনের চাপে ফের চিকিৎসক আসেন। বিস্বনবাবুকে এখান থেকে তুলে নিলে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিষেবাই লাটে উঠবে।’’ সিন্দরির বাসিন্দা ভোলানাথ চন্দ বলেন, ‘‘বরাবাজার ব্লক সদরে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক্তার আসেন। তাঁরা চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করেন। আমাদের এখানে সেই সুবিধাও নেই। সিন্দরি একটি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। এখানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একমাত্র চিকিৎসককে তুলে নিয়ে গেলে আমরা তা মানব না।’’
এ দিকে বেলা যত গড়িয়েছে অবরোধের জেরে আটকে থাকা বাস ও গাড়ির যাত্রীদের ক্ষোভও বেড়েছে। একটি বেসরকারি কলকাতা-বরাবাজার নাইট সার্ভিস বাস ওই অবরোধে আটকে ছিল। বাসের কর্মী লালমোহন প্রামাণিক বলেন, ‘‘বেশ কয়েক জন বরাবাজারের যাত্রী আছেন। কলকাতায় রবিবার সন্ধায় ওরা বাসে উঠেছেন। অবরোধের জেরে ওঁরাই বেশি সমস্যায় পড়েছেন। কখন যে অবরোধ উঠবে কে জানে!’’
অবরোধের খবর জেনে বরাবাজারের ভারপ্রাপ্ত ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক (বিএমওএইচ) স্বপন সিং সর্দার সিন্দরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন। তিনি বলেন, ‘‘বরাবাজারের বিএমওএইচ পরিতোষ সরেন বদলি হয়ে যাওয়ার পর ওই পদেআর কেউ আসেননি। এখনও পর্যন্ত আমি সামাল দিয়ে যাচ্ছি। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমি-সহ মাত্র দু’জন চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু, রোগীদের প্রচণ্ড চাপ। এ জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি থেকে সাময়িক ভাবে এক-দু’জনকে বরাবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। বিস্বনবাবুর ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছিল।’’ স্বপনবাবু ফোনে পুরুলিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে এখানের পরিস্থিতি জানান। পঞ্চায়েত প্রধানও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে জানিয়ে দেন, বিস্বনবাবুকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ প্রত্যাহার করা না হলে অবরোধ চলতেই থাকবে।
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ জানান, বরাবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক সঙ্কট চলায় সিন্দরি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিস্বনবাবুকে সাময়িক ভাবে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ওখানকার বাসিন্দারা যখন চাইছেন না, তা হলে বিস্বনবাবুকে সেখানেই রাখা হবে। আলোচনা শেষে বিএমওএইচ বাইরে বেরিয়ে এসে অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। শেষে সকাল দশটা নাগাদ অবরোধ ওঠে।
চিকিৎসক সঙ্কটের পাশাপাশি সিন্দরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুলেন্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর অভাবের কথাও তোলেন এলাকার মানুষ। পঞ্চায়েত সদস্য ইন্দ্রজিৎবাবু বলেন, ‘‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চারটি অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ থাকলেও সময়ে একটিও পাওয়া যায় না। এক জন মাত্র চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। তিনিও পরের মাসে অবসর নেবেন। তখন পরিষেবার কী হাল হবে?’’ বিএমওএইচ তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সের সমস্যার বিষয়টি লিখিত ভাবে জানাতে বলেছেন।