জাপানি পন্থা ‘হোরেনসো’ কর্মজগতে কেন প্রাসঙ্গিক? ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।
কর্মজগতে দলবদ্ধ ভাবে কাজ হলেও, কোনও দল সাফল্যের সঙ্গে যেমন কাজ করে, তেমনই কোনও দল ব্যর্থও হয়। তার পিছনে যেমন নানা কারণ থাকতে পারে, তেমনই থাকতে পারে নিজেদের মধ্যে তালমিলের অভাবও।
কোনও কর্মক্ষেত্রে বা কর্পোরেট সেক্টরে কর্মীরা যতই দক্ষ হোন না কেন, সাফল্য অধরা রয়ে যেতে পারে সঠিক জ্ঞাপন বা কমিউনিকেশনের অভাবে। হয়তো দেখা গেল, প্রত্যেকে তাঁদের কাজটি করেছেন। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলল না শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে খামতির জন্য। এই খামতি পূরণ করে ব্যবসায়িক সাফল্য কী ভাবে আসতে পারে, সেই দিক নির্দেশনাই করে ‘হোরেনসো’।
কর্মজগতে কী ভাবে লক্ষ্যলাভ সম্ভব, কী ভাবে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে তা নিয়ে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে নানা রকম গবেষণা, সমীক্ষা চলে। তবে এতে কিন্তু কোনও কোনও দর্শনেরও গুরুত্বপূর্ণ থাকে।
‘হোরেনসো’ হল জাপানের ব্যবসায়িক মন্ত্র, যার মূলে তিনটি ভিত্তি রয়েছে। ‘হোকুকু’ বা রিপোর্ট করা, ‘রেনরাকু’ বা তথ্য দেওয়া কিংবা জানানো এবং ‘সোদান’ বা আলোচনা করে পদক্ষেপ করা। বলা হয়, এই তিন ধাপ সফল ভাবে পরিচালিত হলেই কর্পোরেট জগতে সাফল্য আসবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হবে।
‘হোরেনসো’- অনুযায়ী যে কোনও সংস্থায় উপর থেকে নীচের তলা— প্রতিটি ধাপের কর্মীরা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে কোনও একটি দলকে বা ব্যক্তি বিশেষকে অবহেলা করলেই, ফাঁক রয়ে যেতে পারে তথ্য সংক্রান্ত আদান-প্রদানে। কর্মীরা যতই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করুন না কেন, তথ্য যদি যথাস্থানে না পৌঁছয়, নষ্ট হতে পারে ব্যবসা।
হোকুকু বলে, যে কোনও সংস্থার কর্মীদের কাজ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে নিয়মমাফিক ঊর্ধ্বতনকে রিপোর্ট করা উচিত। তাতে যদি ফাঁক থাকে, জ্ঞাপনের একটি অংশ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। কাজের অগ্রগতি, ফলাফল বা কোনও কাজ শেষ হওয়ার পর উচ্চপদস্থ বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সময়মতো অবহিত করা উচিত। ঊর্ধ্বতনেরা কাজের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে জানলে ভুলভ্রান্তি বা অপ্রত্যাশিত সমস্যা দ্রুত নজরে পড়বে। যে কোনও কর্মীর কাজ হবে কাজের অগ্রগতি, বাধা, সমস্যার খুঁটিনাটি উপর মহলকে জানানো।
‘রেনরাকু’-বলে, কাজ সংক্রান্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন— সময়সূচি পরিবর্তন, সমস্যার উদ্ভব, বা প্রাসঙ্গিক তথ্য দ্রুত এবং সঠিক ভাবে সহকর্মী ও সংশ্লিষ্ট দলের সদস্যদের জানানো উচিত। এতে দলের মধ্যে স্বচ্ছতা বজায় থাকে এবং অপ্রয়োজনীয় ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়।
‘সোদান’- বলে, কোনও সমস্যা দেখা দিলে বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে আলোচনা করা এবং পরামর্শ চাওয়ার কথা।
‘হোরেনসো’-র তিন ধাপ স্পষ্ট করে, জ্ঞাপনের প্রক্রিয়াটি আসলে দ্বিমুখী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শুধু মাত্র নির্দেশ দিয়ে যেমন দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, তেমনই বিভিন্ন স্তরে থাকা কর্মীদেরও কাজ সম্পাদনের প্রতিটি ধাপ নিয়ে আলোচনা জরুরি। মোদ্দা কথা হল, বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ই সাফল্যের চাবিকাঠি।
এই দর্শন বা নীতি বলছে, ব্যক্তিগত স্তরে এক-দু’টি বৈঠকে তথ্য আদান-প্রদানের চেয়ে যদি দলের সকলকে নিয়ে চলা যায়, তা হলে কাজের সুবিধা হবে অনেকটাই। যে বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে, তার অগ্রগতি যদি দলের ২-৩ জন জানেন, বাকিদের অজানা থাকে, তা হলে ক্ষেত্র বিশেষে সমস্যা হতে পারে। আবার কাজের বিষয়ে গ্রাহক এবং কর্তৃপক্ষের সমন্বয়টাও জরুরি। অর্থাৎ তথ্যের সঠিক আদান-প্রদানই একটি সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।
কাজের ক্ষেত্রে সুবিধা
জাপানি নীতিটির জনপ্রিয়তার কারণ হল, এর ফলে কর্তৃপক্ষ দ্রুত এবং তৎপরতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভুল সহজে চিহ্নিত করা যায়। পাঁচজন একসঙ্গে সমস্যার সমাধানও করে ফেলতে পারেন। একার বদলে দলগত সাফল্যই সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
কর্মক্ষেত্রে জাপানি পন্থা কতটা প্রাসঙ্গিক, প্রয়োগ কী ভাবে সম্ভব?
· নিয়ম করে ঊর্ধ্বতনের কাছে কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা। এই ব্যাপারে কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
· প্রতিটি দলের মধ্যে যাতে তথ্য এবং ভাবের আদান-প্রদান ঠিক থাকে, তা নিশ্চিত করা। তাদের সম্পর্ক দৃঢ় করা। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান সহজ করে তোলা।
· কর্মীরা যাতে উপর মহলের সঙ্গে নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারেন, সমস্যার সমাধান চাইতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। বৈঠকের মাধ্যমে তা হতে পারে।
· ব্যর্থতার বোঝা ব্যক্তি বিশেষ বা দলের উপর না চাপিয়ে তা নিয়ে পর্যালোচনা করে ভাল কাজে উৎসাহিত করা।
· দলের বোঝাপড়া, সমন্বয়ের দিকটি সঠিক ভাবে পরিচালনা করা।