অন্য মোড়কে রং বিক্রি

এ শহরের সৌন্দর্যের ধারণা তো মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র-বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গেই ভাঙে-গড়ে। নয়ের দশকেই বলিউডের এক নম্বরে চলে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী কাজল।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৭ ১৩:০০
Share:

শ্রীলা মজুমদার।

সান ট্যানের রমরমা বাড়ল, কিন্তু মেরি অ্যানদের কপাল এখনও মন্দ!

Advertisement

সেই কবে অঞ্জন দত্তের গানের নায়ক, বনেদি ব্যবসায়ীর ছেলে মেরি অ্যানকে ছেড়ে ফর্সা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তেমন ব্যবস্থা নাকি এখনও চলছে। অথচ ফ্যাশন দুনিয়া থেকে ফিল্ম জগৎ, সর্বত্রই দাপটের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন ‘ডাস্কি বিউটি’রা। এ শহরের সৌন্দর্যের ধারণা তো মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র-বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গেই ভাঙে-গড়ে। নয়ের দশকেই বলিউডের এক নম্বরে চলে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী কাজল। বিশ্ব সুন্দরীর শিরোপা ঘরে এনেছিলেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, লারা দত্তরা। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে তুলে ধরেছেন অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। ঘরে ঘরে পুরুষদের হার্ট থ্রব চিত্রাঙ্গদা সিংহ, মালাইকা অরোরা খানও শ্যামাঙ্গীই।

তা হলে এখনও ‘ফেয়ারনেস ক্রিমের’ চাহিদা কেন? ফাঁক কোথায়?

Advertisement

মেক-আপ শিল্পী অনিরুদ্ধ চাকলাদার দু’দশকের বেশি সময় ধরে সাজিয়ে চলেছেন এ শহরের মডেল, অভিনেত্রী, আবার সাধারণ ঘরের কনেদেরও। অনিরুদ্ধ বলেন, ‘‘কয়েক জন শ্যামবর্ণ মডেলের সাফল্য দেখে মোটেও বলা যায় না, শহরের মানসিকতা বদলেছে। এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে অভিনয় কিংবা মডেলিংয়ের জন্য উজ্জ্বল গায়ের রঙেরই গুরুত্ব বেশি।’’ শুধু তাই নয়, বিয়ের কনের গায়ের রং যেমনই হোক, ‘বিশেষ দিন’টার জন্য তাঁর কাছে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠার আবদারই আসে বার বার।

তবে যে এত গমের মতো গায়ের রঙের জয়জয়কার চার দিকে? এত জন মডেল-অভিনেত্রী তবে ফর্সা না হয়েও কী করে উঠে এলেন সাফল্যের শীর্ষে?

উত্তরটা সহজ। বিপণন বিশেষজ্ঞদের মতে, গায়ের রং এখন অন্য ভাবে বিকোচ্ছে। যে ভাবে আদিবাসী কোনও মহিলার আবেদন বিকিয়েছে এত দিন ধরে, ঠিক সে ভাবেই এখনও বিকোচ্ছে। মডেলের সঙ্গে যোগ শুধু পণ্যের। যেমন এ শহরের এক নামী গয়না বিপণি সব সময়েই শ্যামবর্ণ মডেল পছন্দ করে। কিন্তু সেও তো সেই পণ্যের স্বার্থেই।

এমন ভাবনা উঠে আসে অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদারের কথাতেও। তিনি বরাবর পরিচিত ‘অন্য ধারার’ অভিনেত্রী হিসেবেই। তাঁর চেহারা থেকে কাজ, সবই ‘মেন স্ট্রিম’ থেকে একটু দূরে। শ্রীলা বলছিলেন, ‘‘আমি আজ যা, তার অনেকটাই আমার গায়ের রঙের জন্য। মৃণাল সেন তাঁর ছবির জন্য এক জন শ্যামবর্ণ অভিনেত্রীকে খুঁজছিলেন। সেই সুবাদেই সিনেমায় প্রথম কাজ পাওয়া।’’ কিছু কাজ হাত থেকে বেরিয়েও গিয়েছে তাঁর গায়ের রঙের কারণেই। কিন্তু রং চাপা না হলে মৃণাল সেনের মাপের পরিচালকের ছবি দিয়ে কেরিয়ার শুরুর সুযোগ তো না-ও হতে পারত, সে কথাও ভুলতে চান না শ্রীলা। বলেন, ‘‘বাণিজ্যিক কিছু ছবি পাইনি বটে। কিন্তু তাতে কী!’’

ঊষসী সেনগুপ্ত।

নিজের গায়ের রং-কেই নিজের পরিচয় বলে মনে করেন ২০১০-এর মিস ইন্ডিয়া এবং অভিনেত্রী ঊষসী সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলায় অনেকেই বলত, আমি কালো। কখনও দুঃখও হয়েছে। বড় হয়ে বুঝলাম সেইটাই আমার প্লাস পয়েন্ট।’’ মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় গিয়েও অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে তাঁর গায়ের রং। এখন তিনি জানেন, গায়ের রংই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বহু দূর।

ঊষসী ও শ্রীলা, দু’জনেই এক বাক্যে মানছেন, বিয়ের বিজ্ঞাপন বা বাণিজ্যের সঙ্গে মিল নেই তাঁদের কাজের জগতের। অনিরুদ্ধের সঙ্গে একমত তাঁরা, কালো মেয়েরা বিয়ের ক্ষেত্রে এখনও আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। গায়ের রঙের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের পাকাপাকি যোগ স্থাপন করে দিয়েছে শাহরুখ খান, দীপিকা পা়ডুকোনদের মতো তারকাদের করা সব বিজ্ঞাপন। সেই ফাঁদ থেকে সাধারণ মনকে মুক্ত করবে কে?

বিপণন বিশেষজ্ঞ রাম রে-ও মনে করান, ডাস্কি বিউটির রমরমা দেখেও আনন্দের কারণ নেই। গায়ের রং ফর্সা হোক বা বাদামি— তার উপরে নির্ভর করে কাউকে সুন্দর বলা মানেই তো বিপণনের চেনা ফাঁদে পা বাড়ানো। তিনি বলেন, ‘‘রেখা ফর্সা নন, কিন্তু তিনি তো সেই কোন কালে জনপ্রিয় হয়েছেন। এখন তো মডেলিং জগতে আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা ফর্সা নন।’’ শুধু তাঁদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এক হতে দেওয়া হয় না সাধারণ মহিলাদের আত্মবিশ্বাসের ধারণাকে। বিজ্ঞাপনের ফাঁদ সেইটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন